পাতা:বিরাজ বৌ - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/১৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বিরাজবৌ
১৯

কাছে বসিয়া পড়িয়া বলিল, এই আশীর্বাদ কর, যদি জ্ঞান হওয়া পর্যন্ত এই দুটি পা ছাড়া সংসারে আর কিছু না জেনে থাকি যদি যথার্থ সতী হই, তবে যেন অসময়ে তাঁর মতই তোমাকে ফিরিয়ে আনতে পারি—তার পরে, এই পায়ে মাথা রেখে যেন মরি—যেন এই সিঁদূর এই নোয়া নিয়েই চিতায় শুতে পাই।

 নীলাম্বর ব্যস্ত হইয়া উঠিয়া বলিল, কি হয়েচে রে বিরাজ, আজ?

 বিরাজের দুই চোখে জল টলটল করিতেছিল, তৎসত্ত্বেও তাহার ওষ্ঠাধরেঃ অতি মৃদু, অতি মধুর হাসি ফুটিয়া উঠিল। বলিল, আর একদিন শুনো, আজ নয়। আজ শুধু আশীর্বাদ কর, মরণকালে যেন এই দুই পায়ের ধুলো পাই, যেন তোমার কোলে মাথা রেখে তোমার মুখের পানে চেয়ে মরতে পারি।

 সে আর বলিতে পারিল না। এইবার তাহার স্বর রুদ্ধ হইয়া গেল।

 নীলাম্বর ভয় পাইয়া তাহাকে জোর করিয়া বুকের কাছে টানিয়া আনিয়া বলিল, কি হয়েছে রে আজ? কেউ কিছু বলেচে কি?

 বিরাজ স্বামীর বুকে মুখ রাখিয়া নিঃশব্দে কাঁদিতে লাগিল; জবাব ছিল না। নীলাম্বর পুনরায় কহিল, কোনদিন ত তুই এমন করিস নি বিরাজ—কি হয়েচে, বল!

 বিরাজ গোপনে চক্ষু মুছিল, কিন্তু মুখ তুলিল না। মৃদুকণ্ঠে বলিল, আর একদিন শুনো।

 নীলাম্বর আর পীড়াপীড়ি করিল না, তেমনই ভাবে বসিয়া থাকিয়া তাহার চুলের মধ্যে ধীরে ধীরে অঙ্গুলি-চালনা করিয়া নিঃশব্দে সান্ত্বনা দিতে লাগিল। সে ক্ষমতার অতিরিক্ত খরচপত্র করিয়া ভগিনীর বিবাহ দিয়া কিছু জড়াইয়া পড়িয়াছিল। সংসারে আর পূর্বের সচ্ছলতা ছিল না। উপর্যুপরি দুই সন অজন্মা; গোলায় ধান নাই, পুকুরে জল নাই, মাছ নাই—কলাবাগান শুকাইয়া উঠিতেছে লেবু বাগানের কাঁচা লেবু ঝড়িয়া পড়িতেছে। তাহার উপর উত্তমর্ণেরা আসা-যাওয়া শুরু করিয়াছিল এবং পুঁটির শ্বশুরও ছেলের পড়ানোর খরচের জন্য মিঠেকড়া চিঠি পাঠাইতেছিলেন। এত কথা বিরাজ জানিত না। অনেক অপ্রীতিকর সংবাদই নীলাম্বর প্রাণপণে গোপন করিয়া রাখিয়াছিল। এখন সে উদ্বিগ্ন হইয়া ভাবিতে লাগিল, বুঝি এই সমস্ত কথাই কেহ বিরাজকে শুনাইয়া গিয়াছে।

 সহসা বিরাজ মুখ তুলিয়া ঈষৎ হাসিল; কহিল একটি কথা জিজ্ঞেস করব, সত্যি জবাব দেবে?

 নীলাম্বর মনে মনে অধিকতর শঙ্কিত হইয়া বলিল, কি কথা?

 বিরাজের সমস্ত সৌন্দর্যের বড় সৌন্দর্য ছিল তার মুখের হাসি। সে সেই হাসি আর একবার হাসিয়া মুখপানে চাহিয়া বলিল, আচ্ছা, আমি কালো-কুচ্ছিত নই ত?

 নীলাম্বর মাথা নাড়িয়া বলিল, না।