পাতা:বিষাদ-সিন্ধু - মীর মোশার্‌রফ হোসেন.pdf/৩১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বিষাদ-সিন্ধু
১৪

ভালবাসার চিন্তাটুকু মস্তকে উদিত হইয়াই একেবারে হৃদয়ের অন্তঃস্থান অধিকার করিয়া বসে। তাহা যখনই মনে উদিত হয়, অন্তরে ব্যথা লাগে, হৃৎপিণ্ডে আঘাত করে, হৃদয়তন্ত্রী বেহাগ রাগে বাজিয়া উঠে। এজিদ আপাততঃ বাহ্য চিন্তাতেই মহাব্যস্ত। কারণ, এই চিন্তার মধ্যে আশা, ভরসা, নিরাশা সকলই রহিয়াছে। কাজেই পূর্ব্বভাবের কিঞ্চিৎ পরিবর্ত্তন বোধ হইতেছে। এজিদের নয়নে, ললাটে ও মুখশ্রীতে যেন ভিন্ন ভাব অঙ্কিত। দেখিলেই বোধ হয়, যেন কোন দগ্ধীভূত বিকৃত ধাতুর উপরে কিঞ্চিৎ রজতের পাকা গিল্টি হইয়াছে। হঠাৎ দেখিলেই চাকচিক্যবিশিষ্ট রজতপাত্র বলিয়াই ভ্রম জন্মে, কিন্তু মনোনিবেশ করিয়া লক্ষ্য করিলে, সমাবৃত বিকৃত ধাতুর পরমাণু অংশ নয়নগোচর হইয়া চাক্‌চিক্যবিশিষ্ট উজ্জ্বলভাব যেন বহু দূরে সরিয়া যায়। পুরবাসিগণ এবং অমাত্যগণ সকলেই রাজপুত্রের তাদৃশ বাহিক প্রসন্নভাব দর্শন করিয়া মহা আনন্দিত হইলেন।

 মারওয়ান যদিও প্রধান মন্ত্রী ছিলেন না, কিন্তু এজিদের বুদ্ধি, বল, সহায়, সাহস ইত্যাদি যত কিছু,সকলই মারওয়ান। প্রধান মন্ত্রী হামান কেবল রাজকার্য্য ব্যতীত সাংসারিক অন্য কোন কার্য্যে মারওয়ানের মতে বাধা দিতে পারিতেন না, কারণ তিনি এজিদের প্রিয়পাত্র। সকল সময়েই সকল বিষয়েই মারওয়ানের সহিত এজিদের পরামর্শ হইত। সে পরামর্শের সময় অসময় ছিল না। কি পরামর্শ, তাহা তাঁহারাই জানিতেন।

 মারওয়ান বলিলেন, “রাজকুমার! মহারাজ বর্ত্তমান না থাকিলে আপনাকে কখনই এত কষ্ট পাইতে হইত না।”

 এজিদ বলিলেন, “পুত্রের স্বাধীনতা কোথায়? কি করি, পিতা বর্ত্তমানে পিতার অমতে কোন কার্য্যে অগ্রসর হওয়া পুত্রের পক্ষে অনুচিত। আমি হাসান-হোসেনের ভক্ত নহি, শাহজাদা বলিয়া মান্য করি না; নতশিরে তাহদের নামে দণ্ডবৎ করি না; সেইজন্য পিতা মহাবিরক্ত। আবার অন্যায় বিচারে একজনের প্রাণ বধ করিয়া স্বার্থসিদ্ধি করিতে সাহস হয় না, ইচ্ছাও করে না। লোকাপবাদ—তাহার পর পরলোকের দণ্ড! আর কেন? মহারাজ যে একটু ইঙ্গিত করিয়াছেন, তাহাতেই ত মনস্কামনা সিদ্ধি—আর কি চাই?