পাতা:বৃহৎ বঙ্গ (দ্বিতীয় খণ্ড) - দীনেশচন্দ্র সেন.pdf/১৪৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

বৃহৎ বঙ্গ و\) বর্ণনায় “ভ্রমর-গীতা”র কথা লিখিত হইয়াছে। মোটামুটি কাহিনীটি একরূপ, তবে পরবর্তী ভক্তি-রত্নাকরের অতিরঞ্জিত ভক্তির বর্ণনা হইতে প্ৰেমবিলাসের সরল স্বাভাবিক বর্ণনা আমাদের কাছে অধিকতর প্রামাণিক মনে হয় । এই ঘটনার পর রাজা স্বয়ং, সভাপণ্ডিত ব্যাসাচাৰ্য্য, রাণী সুদক্ষিণা প্ৰভৃতি সকলেই শ্ৰীনিবাসের নিকট দীক্ষা গ্ৰহণ করিয়াছিলেন । রাজা তঁহার রাজ্যশাসনের ভার শ্ৰীনিবাসের উপর ছাড়িয়া দিয়াছিলেন । গৈরিকবসনপরিহিত সাধুর রাজ্য-শাসনের ভার গ্ৰহণ করা এই নূতন নহে; মহারাজ চন্দ্ৰগুপ্ত চাণক্যের উপর এইরূপ ভার অর্পণ করিয়াছিলেন, দেবপাল তদীয মন্ত্রী দীর্ভপাণির উপর সমস্ত বিষয়ে নির্ভব করিতেন ! প্ৰায় একশত বৎসর পূর্বে ত্রিপুরেশ্বর ঈশান মাণিক্য র্তাহার গুরুদেব বিপিনবিহারীর হন্তে ঋণজলজড়িত ত্রিপুররাজ্যের ভার ন্যস্ত করিয়াছিলেন। বিদ্যাপতি ও চণ্ডীদাসের পর বৈষ্ণব পদকর্তাদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ কবিগণ ও সংকীৰ্ত্তনীয়ারা বিষ্ণুপুর, বাঁকুড়া ও বৰ্দ্ধমান অঞ্চলের লোক। গোবিন্দ দাসের বাড়ী ছিল শ্ৰীখণ্ড (বৰ্দ্ধমান)। ইনি শ্ৰীনিবাস ও নরোত্তমের একান্ত অন্তরঙ্গ, রামচন্দ্ৰ কবিরাজের সহোদর ; জ্ঞান দাসের বাড়ী কঁাদরা, লোচন দাসের বাড়ী কোগ্রাম, আর আর প্রায় সমস্ত বৈষ্ণব কবিই বৰ্দ্ধমান ও বীরভূমনিবাসী। বীরহাম্বিরের বৈষ্ণব ধৰ্ম্মে দীক্ষাগ্ৰহণের ফলে দেশে স্থাপত্যশিল্প বিশেষরূপে শ্ৰীসম্পন্ন হইয়াছিল। বনবিষ্ণুপুরে বহু বৈষ্ণবমন্দির গঠিত হইয়াছিল, তাহদের স্থাপত্য ও কারুকাৰ্য্য বঙ্গদেশে ষোড়শ, সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতাব্দীর কল্যাচর্চার নিদর্শনস্বরূপ। বীরভূম, বাঁকুড়া প্রভৃতি অঞ্চলে পুথির মলাটে, প্রাচীরের গায়, কাষ্ঠফলকে, কাগজে ও কাপড়ে এই সময়ে গৌরাঙ্গবিষয়ক সহস্ৰ সহস্ৰ চিত্র অঙ্কিত হইয়াছে। শ্ৰীনিবাস ধৰ্ম্মপ্রচারকাৰ্য্য খুব বিস্তৃত ভাবে চালাইয়াছিলেন, বিষ্ণুপুরের রাজাদের সাহায্যে শুধু বীরভূম, বাঁকুড়া, বৰ্দ্ধমান প্রভৃতি অঞ্চল নহে, ত্রিপুরা, মণিপুর, ময়নামতী-পাহাড় এবং কুকী প্ৰভৃতি উলঙ্গ পাৰ্ব্বত্য জাতিদের মধ্যে বৈষ্ণবধৰ্ম্মের প্রচার হইয়াছিল। পাৰ্ব্বত্য ত্রিপুররাজ্যের পাহাড়িয়া লোকদিগকে আমি কুমিল্লায় নিম্ন সমতলভূমে প্রায়ই দেখিয়াছি। তাহারা স্ত্রীপুরুষে কাঠ বিক্রয় করিবার জন্য কুমিল্লায় অবতরণ করে এবং তাহদের কেহ কেহ পাহাড়ে ফিরিবার মুখে দোকান হইতে চৈতন্য-চবিতামৃত কিনিয়া লইয়া যায় । তাহারা টিপ্ৰা ভাষায় কথা বলে-সে ভাষা আমাদের নিকট দুর্বোধ, কিন্তু কিছু কিছু ভাঙ্গা বাঙ্গলা বলিতে পারে, অথচ চৈতন্য-চরিতামৃতের মত কঠিন পুস্তক তাহারা লইয়া যায়। শ্ৰীনিবাস ও নরোত্তমের প্রচারকগণ ও তঁহাদের বংশধরেরা যে, গৌড়ীয় বৈষ্ণবধৰ্ম্মপ্রচারের জন্য বিপুল আয়োজন করিয়াছিলেন, তাহাতে সন্দেহ নাই। তঁহাদের সহায় ছিল-বনবিষ্ণুপুর ও খেতুরীর রাজ্যভাণ্ডার। এদিকে শুষ্ঠামানন্দ সমস্ত উড়িষ্যাদেশবাসী রাজন্য বৰ্গকে এই ধৰ্ম্মে দীক্ষিত কবিয়াছিলেন, তঁাহার প্ৰধান শিষ্য রাজা রসিকানন্দের রাজভাগুর-ত্রেই প্রচার কাৰ্য্যের সহায় ছিল। চৈতন্য দীর্ঘকাল উড়িষ্যায় ছিলেন। তথার্কার বহু পল্লীতে গৌরাঙ্গদেবের মূৰ্ত্তি প্রতিষ্ঠিত আছে,