পাতা:বৃহৎ বঙ্গ (দ্বিতীয় খণ্ড) - দীনেশচন্দ্র সেন.pdf/১৫৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

বৃহৎ বঙ্গ وg\6 চৈতন্যের প্ৰেম শিক্ষা দিয়াছিলেন । চৈতন্যের সঙ্কীৰ্ত্তনের খোল ও মন্দিরা বঙ্গদেশের নগরে নগরে পল্লীতে পল্লীতে বাজিয়া উঠিয়াছিল, তাহা এখনও থামে নাই। ইহারা ভিন্ন ধৰ্ম্মের গ্ৰাস হইতে জনসাধারণকে অনেক পরিমাণে রক্ষা করিয়াছিলেন। বলা বাহুল্য যে এই ধৰ্ম্মপ্রচার ও সমাজসংস্কার সমস্তই চৈতন্তের প্রেরণা-জাত। তিনি ভাবের পাগল, ভগবৎ-প্ৰেমানন্দে বিভোর ছিলেন। কিন্তু সর্ববিষয়ে তঁহার ইঙ্গিত ছিল । সেই ইঙ্গিত ক্ষুদ্র গিরিনিবারের মত কালে বিশালতোয় স্রোতস্বিনীতে পরিণত হইয়াছিল। জাতিভেদসম্বন্ধে তাহার উক্তি সুস্পষ্ট, “মোর জাতি-মোর সেবকের জাতি নাই” (চৈ ভা. অস্ত্য ১১)। "সন্ন্যাসী পণ্ডিতগণের করিতে সৰ্ব্বনাশ । নীচ শূদ্ৰ দিয়া করে ধৰ্ম্মের প্রকাশ” (চৈ. চি. অস্ত্য )। রঘুনাথ-দাসের জ্ঞাতি কালিদাস ঝাড়ু ভূঞমালীর উচ্ছিষ্ট খাইয়াছিলেন, চৈতন্য এজন্য তাঁহার সাধুবাদ করিয়াছিলেন। যবন হরিদাসের মৃত্যুকালে চৈতন্য সমবেত ব্ৰাহ্মণমণ্ডলীকে তঁহার পাদোদক পান করাইয়াছিলেন, শ্ৰাদ্ধাদি উপলক্ষে তিনি হরিদাসকে সদব্ৰাহ্মণদের তুল্য আদর ও শ্রদ্ধা দেখাইয়াছেন। জাতি-নির্বিশেষে তাহার প্ৰেম ও উদার ব্যবহার গোডা ব্ৰাহ্মণসমাজে নিষিদ্ধ, এজন্য কীৰ্ত্তনীয়ারা গাহিয়া থাকে,- “সব অ-বিধি, নদের বিধি” (অর্থাৎ যত অনাচার-তাহাই নদীয়ার ধৰ্ম্ম) । শাক্ত কবি চৈতন্যের এই উদারনীতিকে ঠাট্টা করিয়া লিখিয়াছিলেন, “গৌর ব’লে আনন্দে মেতে, একত্রে ভোজন ছত্ৰিশ জেতে, বাগদী কোটাল ধোপা কলুতে একত্র সমস্ত ।” পরবত্তী কালে হিন্দুবিধি অতিক্ৰম করিয়া বৈষ্ণবেরা যে প্রচারকাৰ্য্য চালাইয়া কৃতকাৰ্য্য হইয়াছিলেন, সেই প্রচারকার্য্যের প্রস্রবণ চৈতন্য হইতে নিৰ্গত হইয়াছিল। কিন্তু অষ্টাদশ শতাব্দী হইতে এই বিপুল উদ্যম শ্লথ হইয়া পড়ে। বীরহাম্বির বনবিষ্ণুপুরে বৈষ্ণবধৰ্ম্ম লইয়া একটু বাড়াবাড়ি করিয়াছিলেন, অবশ্য তথাকার শিল্প ও স্থাপত্য বৈষ্ণবপ্রভাবে অত্যন্ত শ্ৰীসম্পন্ন হইয়াছিল। বহু দুর্লভ বৈষ্ণব পুস্তক রাজার পুথিশালায় ংগৃহীত হইয়াছিল। কিন্তু কোন কোন বিষয়ে তিনি সাধাবণ রাজধৰ্ম্মের গণ্ডী অতিক্রম করিয়া গিয়াছিলেন। দৃষ্টান্তস্থলে বলা যাইতে পারে তিনি প্রত্যহ একটা নির্দিষ্টসংখ্যক নাম জপ করার জন্য প্ৰজাদিগকে বাধ্য করিয়াছিলেন । এই নিয়ম - বিধিবদ্ধ হইয়াছিল। লিখিত আছে, কোন কোন লোক রাত্রি জাগিয়া নাম জপ করিত, পাছে ঘুমাইয়া পড়িয়া নিদিষ্টসংখ্যক নাম জপ করিতে অক্ষম হয়, সেই ভয়ে তাহারা নিজেদের টাকি ঘরের টুঙ্গ বা আড়ার সঙ্গে সূতা দিয়া বাধিয়া রাখিত। বসিয়া বসিয়া জপ করিবার সময়ে যদি তন্দ্রাবশে ঝিমাইতে পাকিত, তবে টাকিতে টান পড়িত। তখন জাগ্ৰাৎ হইয়া পুনরায় জপে মনােযোগী হইত। ধীরে ধীরে বৈষ্ণব গোঁসাইগণ প্রচুর ক্ষমতা ও লোকশ্রদ্ধা লাভ করিয়া আভিজাত্যদপী ও কতকটা ধৰ্ম্মের বিকৃত অর্থবাদী হইয়া পড়েন । আমরা বলিতে বাধ্য, চৈতন্য যে ধৰ্ম্ম প্রচার করিয়াছিলেন, বাজলার গোস্বামিগণ-প্ৰবৰ্ত্তিত ধৰ্ম্ম আর সেরূপ নাই । চৈতন্যের অশেষ দৈন্য ছিল, তঁহাকে যদি কেহ ভগবানের অবতার বলিত, তিনি তাহাতে অত্যন্ত বিরক্ত হইতেন। কিন্তু তিনি নবদ্বীপ ত্যাগ করার পর তঁহার সম্বন্ধে বহু আজগুবী গল্পের