পাতা:বৃহৎ বঙ্গ (দ্বিতীয় খণ্ড) - দীনেশচন্দ্র সেন.pdf/১৬৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গুরুবাদ ও পরকীয়া ዓዓS গোস্বামীদিগকে সমাসীন দেখিয়া মনে হয়-ভারতের প্রাচীন ইতিহাসের একটি পৃষ্ঠাও নষ্ট হয় নাই। নব ভারতের পল্লী খুজিলে জীৰ্ণশীর্ণ অবস্থায়—সেই সকল পত্ৰ এখনও পাওয়া যায়। মহারাজ প্রিয়াদশী শুধু “ধৰ্ম্মমহামাত্র” পদের সৃষ্টি করিয়া ক্ষান্ত হন নাই, ধৰ্ম্মের অবস্থা পৰ্য্যবেক্ষণ ও ধৰ্ম্ম প্রচার করিবার উদ্দেশ্যে উচ্চশিক্ষিত চরিত্রাবতী মহিলাদিগকেও সেই ভাবে নিযুক্ত করিতেন। এই স্ত্রীধৰ্ম্মমহামাত্ৰগণের ধারাটিও গোস্বামিনীগণ বজায় রাখিয়াছেন। ইহারা ভদ্রপরিবারে যাতায়াত করিয়া ধৰ্ম্মের অনুশাসন ও তত্ত্ব প্রচার করিতেন। চলিত ভাষায় ইহাদের নাম ছিল “মা গোসাই ।” বৌদ্ধধৰ্ম্ম শেষকালটা দেহতত্ত্ব লইয়া ব্যস্ত ছিল, আমরা পূর্বের এক অধ্যায়ে (১৪ অঃ, ৫ম পঃ, ৫৮৪-৮৫ পৃষ্ঠায়) তাহ বিস্তারিত ভাবে আলোচনা করিয়াছি। মহাপ্রভুর ভাবপ্রবণ ভক্তি-ধৰ্ম্মে এই দেহতত্ত্ব একটা স্থান জুড়িয়া বসিল। গোরক্ষাবিজয়ে দেখিতে পাই, ছদ্মবেশী গোরক্ষ মৃদঙ্গের বোলে “কায় সাধ-কায়া সাধ” এই ধ্বনি তুলিয়া গুরু মীননাথকে উদ্বোধন করিতেছেন । “যাহা নাই ভাণ্ডে, তাহা নাই ব্ৰহ্মাণ্ডে” এই উক্তির সঙ্গে বঙ্গের জনসাধারণ বিশেষভাবে পরিচিত। অনেক সময়ে পূৰ্ববৰ্ত্তী ধৰ্ম্মকে বর্জন করিয়া নহে-আত্মসাৎ করিয়া পরবর্তী ধৰ্ম্ম শিরা উত্তোলন করিয়া থাকে। মহাপ্রভুর নাম করিয়া অনেক কথা বৈষ্ণব-সমাজে প্ৰচলিত হইয়াছে, তাহা বৌদ্ধতন্ত্র ও হিন্দুতন্ত্র হইতে গৃহীত। চণ্ডীদাস স্বয়ং তঁাহার কৃষ্ণকীৰ্ত্তনে “এড়িয়া টানিরে শ্বাস” প্ৰভৃতি তন্ত্রোক্ত শ্বাসনিয়ামক প্ৰাণায়ামের তত্ত্ব প্রচার করিয়াছেন, সহজিয়া পুস্তকমাত্ৰেই হরিভক্তি ও হরিপ্রেমসম্বন্ধে বিশেষ কোন উপদেশ নাই। মহাপ্রভুর অষ্ট সাত্বিক বিকার অথবা শান্ত, দাস্তা, সখ্য, বাৎসল্য মাধুৰ্য্য এই পঞ্চ অবস্থার সম্বন্ধে বিশেষ কোন উল্লেখ সহজিয়াসাহিত্যে দৃষ্ট হয় না। তাহাতে কেবলই দেহতত্ত্বর কথা। অমৃত-রত্নাবলীর প্রথম ও শেষ কথা “সকলের সারা হয় আপন শরীর। নিজ দেহ জানিলে আপনি হবে স্থির।” (৩ পৃঃ) চণ্ডীদাসের উক্তিতেও সেই একই কথা-“নিজ দেহ দিয়া ভজিতে পারে, সহজ ভজন বলিব তারে।” সহজিয়া-সাহিত্যে ভক্তি বা প্ৰেমাবাদ অত্যন্না-সর্বত্ৰ দেহতত্বের কথা । ইহা সেই সুপ্ৰাচীন তান্ত্রিক ধারা। সহজিয়ারা হিন্দুতন্ত্রের সঙ্গে যোগ রাখিতে চেষ্টা করিয়াছেন, কিন্তু বৌদ্ধতন্ত্রই তঁহাদের ভিত্তি। এই সম্প্রদায়ের মধ্যে খুলী-বিশ্বাসী, রাম-বল্লভী, সাহেবন্ধনী, দরবেশী, সহজিয়া, কৰ্ত্তাভজা, বলরামী, হজরতী, গোবরাই, পাগলনাখী, পাচ ফকিরী প্ৰভৃতি যে সকল শ্রেণী আছে, তাহারা হিন্দুগণের প্রধান প্ৰধান সংস্কারগুলির মূলে কুঠারাঘাত করিয়াছেন ; কোন কোন স্থানে মুসলমান গুরু এবং ব্ৰাহ্মণ তাহার শিষ্য; হিন্দুদের মধ্যেও গোমাংস কোন কোন শ্রেণীর নিষিদ্ধ নহে। স্ত্রীজাতিসম্বন্ধে এই সহজিয়াদের যে সকল মত আছে তাহা একেবারে সামাজিক আদর্শকে উলটাপালট করিয়া দিয়াছে। ইহাদের আদর্শ সীতা সাবিত্রী নহেন, সহজিয়াদের মতে র্তাহারা স্বেচ্ছায় তঁহাদের সর্বস্ব স্বামীর পদে বিকাইয়া দেন নাই। হিন্দুসমাজ পতিব্ৰতার স্থান যতটা উচ্চ করিয়া দিয়াছেন, তাহাতে পাতিব্ৰত্যের জন্য প্রচুর তৈলবটের ব্যবস্থা CSV