পাতা:বৃহৎ বঙ্গ (দ্বিতীয় খণ্ড) - দীনেশচন্দ্র সেন.pdf/৩১৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ORR বৃহৎ বঙ্গ না। ইলিয়াড় কাব্য হইতে টেনিসনের গীতি পৰ্য্যন্ত উচ্চশিক্ষিতের পাঠাগারের সমস্ত দ্রব্যই জনসাধারণের পক্ষে নিষিদ্ধ। বিলাতের কয়জন চাষা সেক্সপীয়রের নাটক বা চসারের কাব্যের কথা জানে ? কিন্তু এদেশের কোন চাষী-মুসলমান চাষাকে বাদ দিয়া বলিতেছি। না,-রামায়ণ, মহাভারতের কথা জানে না ? ৫০০ বৎসরের কৃত্তিবাস, বহু প্ৰাচীন ধৰ্ম্মমঙ্গল, এমন কি শূন্য পুরাণ, গোরক্ষাবিজয়, মহীপালের গান, চণ্ডীমঙ্গল, মনসাদেবীর গান—এই চাষারাই জিয়াইয়া রাখিয়াছে। বর্ণজ্ঞান না থাকিলেও পদাবলীর অপূৰ্ব্ব সম্পদ ও পালাগানের আশ্চৰ্য্য কবিত্বের ভাণ্ডারের চাবি ইহাদেরই কাছে। ডাক ও খনার বচন ইহাদেরই কণ্ঠে, কবিকঙ্কণের চরিত্র-বিশ্লেষণের এবং মহাজনের পদ-কীৰ্ত্তনের আসর। ইহারাই জমাইয়া রাখিয়াছে। বঙ্গের যাহা কিছু প্রেম ও জ্ঞানের গবিমা-নিরীক্ষর চাষীরাই তাহার মালিক । ইংরেজী বিদ্যার প্রচলন অবধি যে জ্ঞানের ধারাবাহিকত্ব এতকাল আপামর সাধারণের মধ্যে ( বর্ণজ্ঞান থাকুক বা না থাকুক ) চলিয়া আসিয়াছিল, তাহার গতি থামিয়া গিয়াছে। এই জন্যই বাঙ্গলার চাষা যাহা জানে বা বলে তাহ শুনিয়া বিদেশীরা স্তব্ধ হইয়া যায়, হটন সাহেবের উক্তি কিছুমাত্র অতিবাদ নহে। বাঙ্গলার চাষ কত বিপ্লবের মধ্যে বাস করিয়াছে,-দুৰ্ভিক্ষ, অজন্মা, মহাজন ও জমিদারের অত্যাচার, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, মহামারী এ সকল তো তাহদের নিত্যকার সঙ্গী, তবু ক্ষেতে দাড়াইয়া সে যাহা দেখে, তাহাতে বাস্তব অপেক্ষা অবাস্তবের কথাই তাহার বেশী মনে পড়ে । ইংরেজ কবির আৰ্ত্তিনাদ I am acquainted with sad misery as the galley-slave is with his oar. [ শৃঙ্খলিত জাহাজের ক্রীতদাস যেরূপ জাহাজের দাড়কে চিনে, ( তাহা হইতে তাহার মুক্তি নাই, সারাদিন সেই দাড় টানিতেই হইবে ) দুঃখের সহিত আমি তেমনই পবিচিত ( John Webester ) ] কিন্তু আমাদের চাষা দুঃখকে সর্বাঙ্গে বহন করিয়া অবাস্তবের স্বপ্ন দেখে। বৌদ্ধদৰ্শন ও হিন্দুৰ প্ৰেমশাস্ত্রের ৩ও ৩াহাকে যে উৰ্দ্ধলোকে স্থাপিত করিয়াছে সে আসন টলায় কে ? তাহদের জন্য রামপ্রসাদাদি কবি তাহদের মনের কথাগুলি ছন্দে বাধিয়া দিয়াছেন। ঘাস নিড়াইতে নিড়াইতে, লাঙ্গল চালাইতে চালাইতে সে তাহাই গাহিয়া শান্তি লাভ করে- "মনরে কৃষিকাজ জান না- এমন মানব জীবন রইল পড়ে, আবাদ কর্লে ফলতো সোনা।” কলু ঘানি চালাইতে চালাইতে গাহে—“মা আমায় ঘুরাবি কত, কলুর চোখঢাকা বলদের মত, ভবের গাছে বেঁধে দিয়া মা, পাক দিতেছে অবিরতা-কি দোষ করিলে আমার ছটা রিপুর অনুগত।” দুৰ্য্যোগ, ঝড় তুফানে পড়িয়া যখন তাহার তরীখানি ভুবু ডুবুতখনও সে বাহিরের বিপত্তি অগ্ৰাহ করিয়া তাহার জীবনতারণীব কথা স্মরণ করে- “কাল সমুদ্র দেখে আমার এক যেতে ভয় করে-গুরু আমায় ফেলে যেও নারে!” কিংবা তাহার জীবনতরীর একমাত্র কর্ণধারের কাছে কঁদিয়া বলে, “মন মাঝি তোর বৈঠা নেরেআমি আর বাইতে পারি না। জীবন ভরে বাইলাম বৈঠারে, তরী-ভাটার সময় আর উজায় না।” দিন-মজুর কুয়ো খুঁড়িতে খুড়িতে গায়-“দোষ কারু নয়গো মা-আমি স্বাখাত সলিলে