পাতা:বৃহৎ বঙ্গ (দ্বিতীয় খণ্ড) - দীনেশচন্দ্র সেন.pdf/৩৯০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

b* বৃহৎ বঙ্গ করিয়া শত্রুরক্ত-রঞ্জিত আসি যমুনার জলে ধৌত করিব।” “যমুনার জলে ধোব এই তরবারে।” কোথায় গেল সেই সীতারাম রায়, যিনি মগ ও মুসলমানের অত্যাচার হইতে দেশ রক্ষা করিতে কৃতসঙ্কল্প হইয়াছিলেন ? কোথায় গেল “মোনাহাতী,” ছলনাপূর্বক যাহার মস্তক কৰ্ত্তন করিয়া শত্রুরা নবাবের নিকট উপস্থিত হইলে নবাব বিস্ময়-সহকারে বলিয়া উঠিয়াছিলেন, “মানুষেব এতবড় মাথা আমি দেখি নাই, এই বীরকে ধরিয়া আনিতে পারিলে না ? কি দুৰ্ভাগ্য যে এমন লোকটাকে ছলপূর্বক বধ করিয়া মাথাটা লইয়া আসিয়ােছ।” (৮৪৯ পৃঃ) ষোড়শ ও সপ্তদশ শতাব্দীতে বাঙ্গলা দেশে এই যে বীরত্ব ও জয়পরাজয়ের লীলাখেলা হইয়াছে, তাহা সেই যুগেব বাঙ্গলাসাহিত্যে স্বীয় প্রভাব অঙ্কিত করিয়া রাখিয়াছে। শুধু মাথুরে” নহে, বঙ্গসাহিত্যের অপরাপর বিভাগেও সেই জাতীয় দুঃখের সুরটি বাজিয়া উঠিয়াছিল। কত বীর, কত রাজা যে এই দেশে যুদ্ধে হত হইয়াছেন, তাহার অবধি নাই। কত স্বর্ণচুড়, উজ্জলদীপ-শোভিত রাজ-প্ৰাসাদ, কত নগর-শোভা বিপণী ও প্রমোদ-উদ্যান নৈশ স্বপ্নের ন্যায় বিলীন হইয়া গিয়াছে। এদেশের সে ধূলিকণায় পা দেওয়া যায়, তাহাই ভক্তির অশ্রু-মাখা বিগত গৌরবের শেষ রেণু। কৃত্ত্বিবাস যখন লিখিলেন, “লঙ্কায় আসিয়া দেখে ছিন্নভিন্ন সব । নাহিক সে নৃত্যগীত নাহিক উৎসব”—তখন শ্রোতার মনে কত শত ক্ষুদ্র বিলুপ্ত লঙ্কার স্মৃতি উদিত হওয়ায় তাহার আশ্রমাখা দীর্ঘশ্বাস কবির লেখা সার্থক ও বাস্তবিক করুণাপূর্ণ করিত । কাশীদাস যখন লিখিলেন, “অষ্টাদশ অক্ষৌহিণী যার সঙ্গে যায় । হেন দুৰ্য্যোধন রাজা ধূলায় লুটায়।” তখন কত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দুৰ্য্যোধনের স্মৃতিমথিত করুণ কথা পাঠকের মনে হইত। বঙ্গীয় কবিগণ সংস্কৃতেরই অনুবাদ করুন, কি কোন নূতন বিষয়েরই অবতারণা করুন, তাহারা তাহদের কাহিনী ঘরে আনিয়া বাঙ্গলার ছাচে পুনরায় ঢালাই করিয়া লাইয়াছেন, এইজন্য বঙ্গের প্রাচীন কাব্যগুলি বাঙ্গালীর এত প্রিয় সামগ্রী । মুকুন্দরাম-সম্বন্ধে Cowell সাহেব যাহা বলিয়াছেন, বঙ্গীয় সমস্ত কবি সম্বন্ধেই অল্প বেশী পরিমাণে তাহা খাটে—“কবি স্বর্গের কথাই বলুন বা মৰ্ত্ত্যের কথাই বলুন, তিনি সর্বত্রই নিজ গ্রাম ও সমাজের দৃশ্য আঁকিয়াছেন।” এই ঘরে আনিয়া নিজের প্রাণের রসের ভিয়ান দিয়া কথাগুলি সরস ও জীবন্ত করাব রীতিটা বাঙ্গালী প্ৰাচীন কবিদের বৈশিষ্ট্য । এইজন্য মুকুন্দমাম পশু-জগৎ ও উদ্ভিদ-জগৎ বর্ণনা করিবার সময়েও চমৎকার কৌশলের সঙ্গে বাঙ্গালীগৃহের সুখ-দুঃখের চিত্র উদঘাটন করিয়াছেন—“বনে থাকি বনে খাই, জাতিতে ভালুক। নেউগী চৌধুরী নহি না রাখি। তালুক।” হস্তী বলিতেছে, “বড় নাম, বড় গ্ৰাম, বড় কলেবর। লুকাইতে স্থান নাই বীরের গোচর।” এই সকল কথার ইঙ্গিত অতি স্পষ্ট । কত বিয়োগান্ত নাটকের সার নিংড়াইয়া যে ‘মাথুর’ গান বাচিত হইয়াছিল, তাহা বলিবার নহে। কুমারস্বামী লিখিয়াছেন,-“যে বাণী শতসহস্ৰ লোকের মৰ্ম্মের সংবাদ দেয়, তাহাই প্ৰকৃত কাব্য” - এই সকল গানে বাঙ্গালীর হৃদয় সর্বত্র সাড়া দিয়াছে, এজন্য মাথুরের করুণ, রামায়ণ-মহাভারতের বঙ্গীয় অনুবাদের সুর, ধৰ্ম্মমঙ্গল কাব্যের যুদ্ধ-দৃশ্যগুলি দেশময় ভাবের