পাতা:মুর্শিদাবাদ কাহিনী.djvu/৩৫২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।
৩৪৬
মুর্শিদাবাদ-কাহিনী

কোম্পানীর রাজস্ব-সমিতির দেওয়ান, দেশের একরূপ সর্বেসর্বা বলিলেও অত্যুক্তি হয় না। গঙ্গাগােবিন্দ ও দেবীসিংহের মধ্যে একটু ঈর্ষার ভাব প্রচলিত থাকার কথা শুনা যায়। উভয়েই হেস্টিংসের প্রিয়পাত্র বলিয়া, উভয়ে উভয়কে হিংসার চক্ষে দেখিতেন। উপস্থিত ক্ষেত্রে এই দুই প্রতিদ্বন্দ্বী পুরুষের মিলন হইল। দেবীসিংহ নানাপ্রকারে গঙ্গাগােবিন্দ সিংহকে সন্তুষ্ট করিলেন এবং গঙ্গাগােবিন্দও দেখিলেন যে, দেবীসিংহ ভিন্ন তাহার ও তাহার প্রভু হেস্টিংসসাহেবের আকাঙ্ক্ষাপরিতৃপ্তির জন্য উপযুক্ত ব্যক্তি দুর্লভ। কাজেই এই দুই ভীষণ ব্যক্তির সংযােগে দিনাজপুর প্রদেশে পৈশাচিক অত্যাচারের অভিনয় আরম্ভ হইল।

 দেবীসিংহ ১০০০ হাজার টাকা বেতনে দিনাজপুরের নাবালক রাজার দেওয়ান নিযুক্ত হইলেন। বৈদ্যনাথের বিধবা রানী যদিও অভিভাবকরূপে রহিলেন, তথাপি দেবীসিংহই কার্যতঃ সমস্ত বিষয়ের ভার গ্রহণ করিলেন। তিনি নামে দিনাজপুরের দেওয়ান হইলেও কার্যতঃ সেই প্রদেশের অধীশ্বর হইয়া উঠিলেন। দেবীসিংহ যাহা মনে করতেন, তাহাই অবিলম্বে সম্পাদিত হইত। রাজার শিক্ষাদির ভারও তাহার উপর ন্যস্ত হয়। এরূপ লােকের হস্তে শিক্ষার ভার থাকিলে যেরূপ হইবার সম্ভাবনা, রাধানাথের শিক্ষা দিন দিন তেমনই হইতে লাগিল। দিনাজপুর-সংসারে যে সমস্ত পুরাতন কর্মচারী ছিল, সকলেরই পদচ্যুতি ঘটিল। দেবীসিংহ নিজের মনােমত লােক নিযুক্ত করিলেন। এই সময়ে হেস্টিংসের প্রিয়পাত্র গুডল্যাডসাহেব রঙ্গপুরের কালেক্টর ছিলেন। দেবীসিংহের সহিত তাহার মিত্রতা থাকায়, তাহার পরামর্শ করিয়া রাধানাথের মাসহারা ১৬০০ টাকা হইতে ৬০০ শত টাকা করিয়া দিলেন। ১০০০ টাকা মাসহারার লাঘব হওয়ায় রাধানাথের কিরূপ কষ্ট উপস্থিত হইল, তাহা সকলে অনুমান করিতে পারেন।[১]

 অনেকে মনে করেন, দেবীসিংহ হেস্টিংসসাহেবকে তিন লক্ষ টাকা দিয়া দিনাজপুরের দেওয়ানী লাভ করায়, সেই টাকাসংগ্রহের জন্য তিনি এরূপ পন্থা অবলম্বন করিতে বাধ্য হন। দিনাজপুরের দেওয়ান নিযুক্ত হইয়া দেবীসিংহ পর বৎসরে দিনাজপুর রঙ্গপুর ও ইদ্রাকপুর প্রদেশয়ের ইজারা বন্দোবস্ত করিয়া লয়েন। তৎকালে যে ব্যক্তি যে প্রদেশের দেওয়ান নিযুক্ত হইত, তাহাকে সে প্রদেশের ইজারা দেওয়া হইত না; কিন্তু কল্যাণসিংহ ও দেবীসিংহ এতদুভয়ে দেওয়ান হইয়াও বিহার ও দিনাজপুর প্রদেশদ্বয়ের ইজারা গ্রহণ করেন।[২] দেবীসিংহ ইজারা লইয়া জমিদার ও

  1. দুঃখের বিষয় এই রাধানাথই অবশেষে হেস্টিংসসাহেবের প্রশংসা করিয়া লিখিয়া পাঠাইয়াছিলেন। যে হেস্টিংস তাঁহাদের সর্বনাশ করিতে বুটি করেন নাই, সে হেস্টিংসের সুবিচারের কথা তিনিও উল্লেখ করিয়াছিলেন। আমাদের দেশের লােকেরা এরূপ না হইলে দেশের এরূপ দুর্ভাগ্য ঘটিবে কেন?
  2. Minutes of the Evidence of W. H's Trial, p. 1260.