পাতা:মুর্শিদাবাদ কাহিনী.djvu/৩৭৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।
৩৭০
মুর্শিদাবাদ-কাহিনী

প্রতাপে দুর্দান্ত মহারাষ্ট্রীয়গণ বারংবার বঙ্গভূমি হইতে বিতাড়িত হইয়াছিল; বাঙ্গলার প্রজাগণ অত্যাচারের হস্ত হইতে নিষ্কৃতি লাভ করিয়া যাঁহাকে লক্ষ লক্ষ আশীর্বাদ করিয়াছিল; যাঁহার ন্যায়ানুমোদিত শাসনে বাঙ্গলার ইতিহাস অলঙ‍ক‍ৃত হইয়া রহিয়াছে; তিনিও আজ আঁধারে খোশবাগের বৃক্ষচ্ছায়ায় চিরনিদ্রিত। দুই একখানি সামান্য প্রস্তর, তাঁহার সমাধির উপর স্থাপিত না হইলে কেহ তাঁহাকে জানিতে পারিত না। একটি সামান্য অক্ষর পর্যন্ত তাঁহার পরিচয় দিতেছে না। আর সিরাজ-আলিবর্দীর পরম আদরের ধন, হতভাগ্য সিরাজ, সে ত আঁধারে থাকিবার উপযুক্তই বটে। কে তাহাকে চিনিতে চায়, কে তাহাকে জানিতে চায়? ‘আঁধারের কীটাণুর’ ন্যায় তাহার আঁধারে মিশিয়া থাকাই উচিত। তাহার সমাধি ভূমির সহিত মিশিয়া আছে। একখানি সামান্য প্রস্তর বা ইষ্টক পর্যন্ত নাই, যে তাহার পরিচয় দেয়! নামাঙ্কনের কথা দূরে থাকুক, কেহ না বলিয়া দিলে, সহসা তাহার সমাধি চিনিতে পারা যায় না! সহোদর ও প্রিয়তমা মহিষী লুৎফ উন্নেসার সহিত হতভাগ্য ভূগর্ভে শায়িত। মহম্মদী বেগের তরবারি-আঘাতে যে দেহ বিখণ্ডিত হইয়া মুর্শিদাবাদের পথে পথে ঘুরিয়াছিল, এতদিন হয়ত তাহ৷ মাটি হইয়া গিয়াছে! ইংরেজ কোম্পানীর কণ্টক এতদিনে ধূলারাশিতে পরিণত হইয়াছে!

 যে রূপের মত রূপ তৎকালে সমস্ত বাঙ্গলায় ছিল না, সেই সৌন্দর্যরাশি পৃথিবীর অঙ্গে মিশিয়া গিয়াছে। তাহার প্রতি সহানুভূতি করিতে কেহ নাই,—তাহার হইয়া দুই এক কথা বলিতে কাহাকেও দেখিতে পাই না। কেই বা তাহার প্রতি করুণাপরবশ হইয়া দুইচারি বিন্দু অশ্রুবর্ষণ করিবে? যদি তাহার জন্য কাহারও সামান্যমাত্র দয়ার উদ্রেক হইত, তাহা হইলে তাহার সমাধি এর‍ূপ অজ্ঞাত অবস্থায় বৃক্ষান্ধকারে মিশিয়া থাকিত না। অনেক দিন পরে তাহার সংস্কার হইয়াছে সত্য, কিন্তু যাহাতে লোকে সিরাজের সমাধি বলিয়া চিনিতে পারে, তাহার ত’ কোনই নিদর্শন দেখিলাম না। ইংরেজ ঐতিহাসিকগণ যেমন তাহাকে অপদার্থ বলিয়া কত ব্যাখা করিয়াছেন, তাহার সমাধিও সেইর‍ূপ সাক্ষ্য দিতেছে। সিরাজ অকর্মণ্য হউক, নিষ্ঠ‌ুর হউক, অত্যাচারী হউক, কিন্তু যাহার নাম বাঙ্গলাদেশে,—বাঙ্গলায় কেন, ভারতবর্ষে ও ইউরোপে প্রবাদবাক্যের ন্যায় প্রচলিত, তাহার একটা সামান্য চিহ্ন থাকাও কি উচিত নহে? যাহার সহিত ইংরেজরাজত্বের ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ, তাহার পরিচয়ের কি আবশ্যক নাই? তাহার সমাধি কি ভূমির সহিত মিশিয়া থাকিবে? কাহাকেও তাহার সংবাদ লইতে দেখি না। বৎসর বৎসর ভাগীরথী সমাধির নিকটস্থ হইয়া থাকেন; যেন তাহাদের সংবাদ লইতে তাঁহার ইচ্ছা হইয়া থাকে। একদিন তাঁহার তীরে যাহারা কীড়া করিয়াছিল, যে আলিবর্দী ও সিরাজ এক সময়ে তাঁহার তীরে বিজয়নিশান উড়াইয়াছিল, আনন্দ-কোলাহলে তাঁহার তরঙ্গরাশিকে উচ্ছ্বসিত করিয়াছিল, তাহাদের সংবাদ জানিতে ইচ্ছা করিয়াই যেন কেবল তিনিই অগ্রসর হইয়া থাকেন। কলকলরবে সংবাদ জিজ্ঞাসা করিয়া আবার দূরে প্রস্থান করেন। হতভাগ্য