পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অষ্টম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/২১৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

২০২ রবীন্দ্র-রচনাবলী মাথার চুল থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত অপেক্ষা করে আছে—যেন সমস্ত গায়ের রক্ত বাইরের দিকে কান পেতে রয়েছে। খুব বেশি করে কাজ করবার চেষ্টা করলুম। আমার শোবার ঘরের মেজে যথেষ্ট পরিষ্কার ছিল—তবু নিজে দাড়িয়ে ঘড়ী-ঘড়া জল ঢালিয়ে সাফ করাসুম । আলমারির ভিতর জিনিসপত্র একভাবে সাজানো ছিল, সে-সমস্ত বের করে, ঝেড়ে ঝুড়ে বিনা প্রয়োজনে অন্ত রকম করে সাজালুম। সেদিন নাইতে আমার বেলা দুটো হয়ে গেল । সেদিন বিকেলে চুল বাধা হল না, কোনোমতে এলোচুলটা পাকিয়ে জড়িয়ে নিয়ে ভাড়ারঘরটা গোছাবার কাজে লোকজনকে ব্যতিব্যস্ত করে তোলা গেল । দেখি ইতিমধ্যে ভাড়ারে চুরি অনেক হয়ে গেছে—তা নিয়ে কাউকে বকতে সাহস হল না, পাছে এ-কথা কেউ মনে-মনেও জবাব করে, এতদিন তোমার চোখ দুটে৷ ছিল কোথা ? সেদিন ভূতে পাওয়ার মতো এইরকম গোলমাল করে কাটল । তার পরদিনে বই পড়বার চেষ্টা করলুম। কী পড়লুম কিছুই মনে নেই কিন্তু এক-একবার দেখি ভূলে অন্যমনস্ক হয়ে বই-হাতে ঘুরতে-ঘুরতে অন্তঃপুর থেকে বাইরে যাবার রাস্তার জানলার একটা খড়খড়ি খুলে চুপ করে দাড়িয়ে আছি । সেইখান থেকে আঙিনার উত্তর দিকে আমাদের বাইরের এক-সার ঘর দেখা যায় । তার মধ্যে একটা ঘর মনে হল আমার জীবন-সমুদ্রের ওপারে চলে গিয়েছ। সেখানে আর খেয়া বইবে না । চেয়ে আছি তো চেয়েই আছি। নিজেকে মনে হল আমি যেন পরশুদিনকার আমির ভূতের মতো—সেই সব জায়গাতেই আছি তবুও নেই। এক সময় দেখতে পেলুম, সন্দীপ একখানা খবরের কাগজ হাতে করে ঘর থেকে বারান্দায় বেরিয়ে এলেন। স্পষ্ট দেখতে পেলুম তার মুখের ভাবে বিষম চাঞ্চল্য। এক-একবার মনে হতে লাগল যেন উঠোনটার উপর, বারান্দার রেলিংগুলোর উপর রেগে রেগে উঠছেন । খবরের কাগজটা ছুড়ে ফেলে দিলেন—যদি পারতেন তো খানিকটা আকাশ যেন ছিড়ে ফেলে দিতেন । প্রতিজ্ঞ আর থাকে না । যেই আমি বৈঠকখানার দিকে যাব মনে করছি এমন সময় হঠাৎ দেখি পিছনে আমার মেজো জা দাড়িয়ে। ওলো, অবাক করলি যে !—এই কথা বলেই তিনি চলে গেলেন । আমার বাইরে যাওয়া হল না । পরের দিন সকালে গোবিন্দর মা এসে বললে, ছোটোরানীমা ভাড়ার দেবার বেলা হল । আমি বললুম, হরিমতিকে বের করে নিতে বল।—এই বলে চাবির গোছা ফেলে