পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অষ্টাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/১২৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

প্ৰবন্ধ Σ ο Α অল্পক্ষণের জন্যে আপনি আমাদের মধ্যে এসেছেন। কিন্তু সেই সৌভাগকে আমি অল্প বলে মনে করি নে। আমার নিবেদন এই যে আমার এ কথাকে। আপনি অত্যুক্তি বলে মনে করবেন না ধ্যে আপনার দর্শন আমাদের হৃদয়ের মধ্যে নূতন শক্তি সঞ্চার করেছে। প্রেমের উপদেশ মুখে ল’লে। ফল হয় না, যারা প্রেমিক তাদের সঙ্গই প্রেমের স্পর্শমণি, তার স্পর্শে, আমাদের অস্তরে যেটুকু ভালোবাসা আছে তার মূল্য বেড়ে যায়। ] অল্পক্ষণের জন্য আপনাকে আমরা পেয়েছি। কিন্তু এই ঘটনাকে ক্ষণের মাপ দিয়ে পরিমাপ করা যায় না। যে মহাপুরুষদের হৃদয় সকল মানুষের জন্য, সকল দেশই যাদের দেশ, তারা যেকালকে উপস্থিতিমতো অধিকার করেন তাকে অতিক্রম করেন, তারা সকল কালের। এখানে আপনার ক্ষণিক উপস্থিতি আশ্রমের হৃদয়ে স্থায়ী হয়ে রইল। আপনার জীবন সত্যে প্রতিষ্ঠিত। এই সত্যের প্রভােব আপনি চারি দিকে কী রকম বিকীর্ণ করেন এই অল্প সময়ের মধ্যে তা আমরা অনুভব করেছি। জেনেছি। আমাদের সকল কর্ম এই সন্তাবোধের অভাবে প্রতিদিন ব্যর্থ হচ্ছে। অপরাজেয় সত্যের জোরেই প্রেমের মন্ত্রে এই শতধাবিদীর্ণ দুর্ভাগ্য দেশের আত্মঘাতী ভ্ৰাতৃবিদ্বেষের বিষ অপনয়ন করবেন, বিধাতার এই সংকল্পেই আপনার আবির্ভাব। আপনার সেই চরিত্ৰশক্তির কিছু উদাম আমাদের আশ্রমবাসীর মনে আপনি সঞ্চার করে গেছেন তাতে আমার সংশয় নেই। আপনি আমাদের কৃতজ্ঞচিত্তের অভিবাদন গ্রহণ করুন। একান্তমনে এই কামনা করি ভগবানের প্রসাদে দীর্ঘজীবী হয়ে আমাদের পীড়িত দেশকে আরোগোর পথে নিয়ে যান। { ১ সেপ্টেম্বর ১৯৩৪ | দিনেন্দ্রনাথ অকস্মাৎ কাল দিনেন্দ্রনাথের মৃত্যুসংবাদ আশ্রমে এসে পৌঁছল। শোকের ঘটনা উপলক্ষ করে আনুষ্ঠানিকভাবে যে শোকপ্রকাশ করা হয় তার প্রথাগত অঙ্গ যেন একে না মনে করি। বর্তমান ছাত্রছাত্রীরা সকলে দিনেন্দকে ব্যক্তিগতভাবে জানত না- কর্মের যোগে সম্বন্ধও তার সঙ্গে ইদানীং এখনকার অল্প লোকের সঙ্গেই ছিল। অধ্যাপকেরা সকলেই এক সময়ে তীর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এবং তার সঙ্গে স্নেহ প্রেমের সম্বন্ধ তাদের ঘনিষ্ঠ হতে পেরেছিল। যে শোকের কোনো প্ৰতিকার নেই তাকে নিয়ে সকলে মিলে আন্দোলন করে কোনো লাভ নেই এবং আত্মীয়বন্ধুদের যে-শোক, অন্য সকলের মনে তার সত্যতাও প্রবল নয়। এই মৃত্যুকে উপলক্ষ ক'রে মৃত্যুর স্বরূপকে চিন্তা করবার কথা মনে রক্ষা করা চাই। সমস্ত জগৎকে ব্যাপ্ত করে এমন কোনো কোণ নেই যেখানে প্রাণের সঙ্গে মৃত্যুর সম্বন্ধ লীলায়িত হচ্ছে না; এই যে অনিবাৰ্য সঙ্গ, এ যে শুধু অনিবার্য তা নয়, এ না হলে মঙ্গল হত না- দুঃখকে মানতেই হবে, শোক-দুঃখ মিলন-বিচ্ছেদ উন্মীলন-নিমীলনেই সমাজ গ্রথিত— এই আঘাত-অভিঘাতের মধ্য দিয়েই সৃষ্টির প্রক্রিয়া চলছে। এর মধ্যে যে দ্বন্দ্ব যে কঠোরতা আছে সেইটি না থাকলেই যথার্থ দুঃখের দিকটাই দেখব, তার মধ্যে যে অপরাজিত সত্য সে তো অবসন্ন হয় না— অথচ মানুষের দুঃখের কি অন্ত আছে? মৃত্যুকে যদি বিচ্ছিন্ন করে দেখি তা হলেই আমরা অসহিষ্ণু হয়ে নালিশ করি এর মধ্যে মঙ্গল কোথায়? এই দুঃখের মধ্যেই মঙ্গল নিহিত আছে, নইলে দুর্বলতায় সৃষ্টি অভিভূত হত— দুঃখ আছে বলেই মনুষ্যত্বের সম্মান। দুঃখের আঘাত, বেদনা মানুষের জীবনে নানান কান্নায় প্রকাশ; ইতিহাসের মধ্যে যদি দেখি তা হলে দেখব অপরিসীম দুঃখকে আত্মসাৎ করে মানুষ আপন সভ্যতাকে প্রতিষ্ঠিত করেছে, সে-সব এখন কাহিনীতে পরিণত। ইতিহাসে