VS) R8 রবীন্দ্র-এরচনাবলী পরিচয়লাভের পূর্বেই যিনি শকুন্তলা সম্বন্ধে আশ্বাস দিয়াছিলেন, তিনিই। তিনি মনের বাসনা ; তিনি মানুষকে সত্য মিথ্যা ঢের কথা অজস্র বলিয়া থাকেন ; কোনোটা খাটে, কোনোটা খাটে না, দুষ্যন্তের এবং আমারটা খাটিয়া গিয়াছিল । আমার এই অপরিচিত প্রতিবেশিনী বিবাহিতা কি কুমারী কি ব্ৰাহ্মণ কি শূদ্র, সে সংবাদ লওয়া আমার পক্ষে কঠিন ছিল না, কিন্তু তাহা করিলাম না, কেবল নীরব চকোরের মতো বহুসহস্ৰ যোজন দূর হইতে আমার চন্দ্ৰমণ্ডলটিকে বেষ্টন করিয়া করিয়া উর্ধর্বকণ্ঠে নিরীক্ষণ করিবার চেষ্টা করিলাম । পরদিন মধ্যাহ্নে একখানি ছোটাে নীেকা ভাড়া করিয়া তীরের দিকে চাহিয়া জোয়ার বাহিয়া চলিলাম, মাল্লাদিগকে দাড় টানিতে নিষেধ করিয়া দিলাম । আমার শকুন্তলার তপোবনকুটিরটি গঙ্গার ধারেই ছিল। কুটিরটি ঠিক কথের কুটিরের মতো ছিল না ; গঙ্গা হইতে ঘাটের সিঁড়ি বৃহৎ বাড়ির বারান্দার উপর উঠিয়াছে, বারান্দাটি ঢালু কাঠের ছাদ দিয়া ছায়াময় । আমার নীেকাটি যখন নিঃশব্দে ঘাটের সম্মুখে ভাসিয়া আসিল, দেখিলাম আমার নবযুগের শকুন্তলা বারান্দার ভূমিতলে বসিয়া আছেন ; পিঠের দিকে একটা চৌকি, চৌকির উপরে গোটাকতক বই রহিয়াছে, সেই বইগুলির উপরে তাহার খোলা চুল স্তৃপাকারে ছড়াইয়া পড়িয়ছে, তিনি সেই চৌকিতে ঠেস দিয়া উর্ধর্বমুখ করিয়া উত্তোলিত বাম বাহুর উপর মাথা রাখিয়াছেন, নীেকা হইতে র্তাহার মুখ অদৃশ্য, কেবল সুকোমল কণ্ঠের একটি সুকুমার বক্ররেখা দেখা যাইতেছে, খোলা দুইখানি পদপল্লবের একটি ঘাটের উপরের সিডিতে এবং একটি তাহার নীচের সিঁড়িতে প্রসারিত, শাড়ির কালো পাড়টি বাকা হইয়া পডিয়া সেই দুটি পা বেষ্টন করিয়া আছে । একখানা বই মনোযোগহীন শিথিল দক্ষিণ হস্ত হইতে স্রস্ত হইয়া ভূতলে পিডিয়া রহিয়াছে। মনে হইল, যেন মূর্তিমতী মধ্যাহ্ন লক্ষ্মী ! সহসা দিবসের কর্মের মাঝখানে একটি নিম্পন্দসুন্দরী অবসরপ্রতিমা । পদতলে গঙ্গা, সম্মুখে সুদূর পরপর এবং উর্ধেব তীব্রতাপিত নীলাম্বর তাহদের সেই অন্তরাত্মারূপিণীর দিকে, সেই দুটি খোলা পা, সেই অলসবিন্যস্ত বাম বাহু, সেই উৎক্ষিপ্ত বঙ্কিম কণ্ঠরেখার দিকে নিরতিশয় নিস্তব্ধ একাগ্রতার সহিত নীরবে চাহিয়া আছে । যতক্ষণ দেখা যায় দেখিলাম, দুই সজলপল্লব নেত্রপাতের দ্বারা দুইখানি চরণপদ্ম বারংবার নিছিয়া মুছিয়া লইলাম । অবশেষে নীেকা যখন দূরে গেল, মাঝখানে একটা তীরতরুর আড়াল আসিয়া পড়িল, তখন হঠাৎ যেন কী একটা ত্রুটি স্মরণ হইল, চমকিয়া মাঝিকে কহিলাম, “মাঝি, আজ আর আমার হুগলি যাওয়া হইল না, এইখান হইতেই বাড়ি ফেরো ।” কিন্তু ফিরিবার সময় উজানে দাড় টানিতে হইল, সেই শব্দে আমি সংকুচিত হইয়া উঠিলাম। সেই দাড়ের শব্দে যেন এমন কাহাকে আঘাত করিতে লাগিল যাহা সচেতন সুন্দর সুকুমার, যাহা অনন্ত-আকাশ-ব্যাপী অথচ একটি হরিণশাবকের মতো ভীরু । নীেকা যখন ঘাটের নিকটবতী হইল। তখন দাড়ের শব্দে আমার প্রতিবেশিনী প্রথমে ধীরে মুখ তুলিয়া মৃদু কৌতুহলের সহিত আমার নীেকার দিকে চাহিল, মুহুর্ত পরেই আমার ব্যগ্রব্যাকুল দৃষ্টি দেখিয়া সে চকিত হইয়া গৃহমধ্যে চলিয়া গেল ; আমার মনে হইল, আমি যেন তাহাকে আঘাত করিলাম, যেন কোথায় তাহার বাজিল ! তাড়াতাড়ি উঠবার সময় তাহার ক্রোড় হইতে একটি অর্ধদষ্ট স্বল্পপঙ্ক পেয়ারা গড়াইতে গড়াইতে নিম্ন সোপানে আসিয়া পড়িল, সেই দশনচিহ্নিত অধরচুম্বিত ফলটির জন্য আমার সমস্ত অন্তঃকরণ উৎসুক হইয়া উঠিল, কিন্তু মাঝিমাল্লাদের লজ্জায় তাহা দূর হইতে নিরীক্ষণ করিতে করিতে চলিয়া গেলাম। দেখিলাম, উত্তরোত্তর লোলুপায়মান জোয়ারের জল ছলছল লুব্ধ শব্দে তাহার লোল রসনার দ্বারা সেই ফলটিকে আয়ত্ত করিবার জন্য বারংবার উন্মুখ হইয়া উঠিতেছে, আধা ঘণ্টার মধ্যে তাহার মূল্যবাদ চরিতার্থ হইবে ইহাই কল্পনা করিয়া ক্লিাচিত্তে আমি আমার বাড়ির ঘটে আসিয়া ণ হইলাম ।
পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৪১
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।
![](http://upload.wikimedia.org/wikisource/bn/thumb/3/31/%E0%A6%B0%E0%A6%AC%E0%A7%80%E0%A6%A8%E0%A7%8D%E0%A6%A6%E0%A7%8D%E0%A6%B0-%E0%A6%B0%E0%A6%9A%E0%A6%A8%E0%A6%BE%E0%A6%AC%E0%A6%B2%E0%A7%80_%28%E0%A6%8F%E0%A6%95%E0%A6%BE%E0%A6%A6%E0%A6%B6_%E0%A6%96%E0%A6%A3%E0%A7%8D%E0%A6%A1%29_-_%E0%A6%B8%E0%A7%81%E0%A6%B2%E0%A6%AD_%E0%A6%AC%E0%A6%BF%E0%A6%B6%E0%A7%8D%E0%A6%AC%E0%A6%AD%E0%A6%BE%E0%A6%B0%E0%A6%A4%E0%A7%80.pdf/page341-1024px-%E0%A6%B0%E0%A6%AC%E0%A7%80%E0%A6%A8%E0%A7%8D%E0%A6%A6%E0%A7%8D%E0%A6%B0-%E0%A6%B0%E0%A6%9A%E0%A6%A8%E0%A6%BE%E0%A6%AC%E0%A6%B2%E0%A7%80_%28%E0%A6%8F%E0%A6%95%E0%A6%BE%E0%A6%A6%E0%A6%B6_%E0%A6%96%E0%A6%A3%E0%A7%8D%E0%A6%A1%29_-_%E0%A6%B8%E0%A7%81%E0%A6%B2%E0%A6%AD_%E0%A6%AC%E0%A6%BF%E0%A6%B6%E0%A7%8D%E0%A6%AC%E0%A6%AD%E0%A6%BE%E0%A6%B0%E0%A6%A4%E0%A7%80.pdf.jpg)