পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৫৩৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

&Y8 রবীন্দ্র-রচনাবলী দেখিতে হইবে। এক-একটা সময়ে কাজের ভিড় পড়িয়া যায়, কাজের হাট বসিয়া যায়, অনেকে মিলিয়া হোহা করিয়া একটা কাজের কারখানা বসাইয়া দেন– তখন কাজ করিতে অথবা কাজের ভান করিতে একটা আমোদ আছে। তখন সেই কার্যাড়ম্বর নাট্যরস জন্মাইয়া মানুষকে মত্ত করিয়া তুলে, বিশেষত একটা তুমুল কোলাহলে সকলে বাহ্যজ্ঞান বিশ্বত হইয়া একপ্রকার বিহবল হইয়া পড়েন। কিন্তু রামমোহন রায়ের সময়ে বঙ্গসমাজের সে অবস্থা ছিল না। তখন কাজেতে মত্ততাস্থখ ছিল না ; অত্যন্ত ব্যস্তসমস্ত হইবার, ইসিফাস করিবার আনন্দ ছিল না ; একাকী অপ্ৰমত্ত থাকিয়া ধীরভাবে সমস্ত কাজ করিতে হইত। সঙ্গিহীন স্থগভীর সমুদ্রের গর্তে যেমন নীরবে অতি ধীরে ধীরে দ্বীপ নির্মিত হইয়া উঠে, তাহার সংকল্প তেমনি অবিশ্রাম নীরবে স্বধীরে তাহার গভীর হৃদয় পরিপূর্ণ করিয়া কাৰ্ধ-আকারে পরিস্ফুট হইয়া উঠিত। ব্যস্তসমস্ত চটুল স্রোতস্বিনীতে যেমন দেখিতে দেখিতে আজ চড় পড়ে কাল ভাঙিয়া যায়— সেরূপ ভাঙিয়া গড়িয়া কাজ যত না হউক, খেলা অতি চমৎকার হয়— তাহদের সেকালে সেরূপ ছিল না । মহত্ত্বের প্রভাবে, হৃদয়ের অম্বুরাগের প্রভাবে কাজ না করিলে, কাজ করিবার আর কোনো প্রবর্তনাই তখন বর্তমান ছিল না। অথচ কাজের ব্যাঘাত এখনকার চেয়ে ঢের বেশি ছিল। রামমোহন রায়ের যশের প্রলোভন কিছুমাত্র ছিল না। তিনি যতগুলি কাজ করিয়াছিলেন কোনো কাজেই তাহার সমসাময়িক স্বদেশীয়দিগের নিকট হইতে যশের প্রত্যাশ করেন নাই। নিন্দাগ্নানি শ্রাবণের বারিধারার স্তায় তাহার মাথার উপরে অবিশ্রাম বর্ধিত হইয়াছে– তবুও তাহাকে তাহার কার্ধ হইতে বিরত করিতে পারে নাই। নিজের মহত্ত্বে র্তাহার কী অটল আশ্রয় ছিল, নিজের মহত্ত্বের মধ্যেই তাহার হৃদয়ের কী সম্পূর্ণ পরিতৃপ্তি ছিল, স্বদেশের প্রতি তাহার কী স্বার্থপূন্ত স্থগভীর প্রেম ছিল ! তাহার স্বদেশীয় লোকেরা তাহার সহিত যোগ দেয় নাই, তিনিও তাহার সময়ের স্বদেশীয় লোকদের হইতে বহুদূরে ছিলেন, তথাপি তাহার বিপুল হৃদয়ের প্রভাবে স্বদেশের যথার্থ মর্মস্থলের সহিত আপনার স্বধৃঢ় যোগ রক্ষা করিতে পারিয়াছিলেন । বিদেশীয় শিক্ষায় সে বন্ধন ছিন্ন করিতে পারে নাই এবং তদপেক্ষা গুরুতর যে স্বদেশীয়ের উৎপীড়ন তাহাতেও সে বন্ধন বিচ্ছিন্ন হয় নাই। এই অভিমানশূন্ত বন্ধনের প্রভাবে তিনি স্বদেশের জন্ত সম্পূর্ণ আত্মবিসর্জন করিতে পারিয়াছিলেন। তিনি কী না করিয়াছিলেন । শিক্ষা বল, রাজনীতি বল, বঙ্গভাষা বল, বঙ্গসাহিত্য বল, সমাজ বল, ধর্ম বল, কেবলমাত্র হতভাগ্য স্বদেশের মুখ চাহিয়া তিনি কোন কাজে না রীতিমত হস্তক্ষেপ করিয়াছিলেন। কোন কাজটাই বা তিনি