পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩০৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

নীেকাডুবি Sbr> তোমাকে ডাকি নাই । রমেশ কমলার হাত চাপিয়া ধরিয়া কহিল, ”আচ্ছা, তুমি আমার ঘরে এসো- সেখানে বাহিরের লোক কেহ নাই ।” কমলা কম্পিত্যকলেবরে তাড়াতাড়ি রমেশের হাত ছাড়াইয়া লইয়া পাশের ঘরে গিয়া দ্বার রুদ্ধ করিল। রমেশ বৃঝিল, এ-সমস্তই বাড়ির কোনাে মেয়ের ষড়যন্ত্ৰ— এই বুঝিয়া পুলকিতদেহে বাহিরের ঘরে গেল। চিত হইয়া পড়িয়া আর-একবার ‘পায়োনিয়রটা টানিয়া লইয়া তাহার বিজ্ঞাপনশ্রেণীর উপরে চোখ বুলাইতে লাগিল, কিন্তু কিছুই অর্থগ্রহ হইল না। তাহার হৃদয়াকাশে নানারঙের ভাবের মেঘ শৈল রুদ্ধঘরে ঘা দিল ; কেহ দরজা খুলিল না। তখন সে দরজার খড়খড়ি খুলিয়া বাহির হইতে হাত গলাইয়া দিয়া ছিটিকিনি খুলিয়া ফেলিল। ঘরে ঢুকিয়া দেখে কমলা মেজের উপর উপুড় হইয়া পড়িয়া দুই হাতের ভিতর মুখ লুকাইয়া কঁদিতেছে। শৈল আশ্চর্য হইয়া গেল। এমনি কী ঘটনা ঘটিতে পারে যাহার জন্য কমলা এত আঘাত পায় ! তাড়াতাড়ি তাহার পাশে বসিয়া তাহার কানের কাছে মুখ রাখিয়া স্নিগ্ধস্বরে বলিতে লাগিল, “কেন ভাই, তোমার কী হইয়াছে, তুমি কেন কঁদিতেছ?” কমলার এই-সকল আকস্মিক আবেগের প্রবলতা তাহার নিজের পক্ষে এবং অন্যের পক্ষে বোঝা ভারি শক্ত । ইহার মধ্যে যে তাহার কত দিনের গুপ্তবেদনার সঞ্চয় আছে তাহা কেহই জানে না । কমলা আজ একটা কল্পনালোক অধিকার করিয়া বেশ গুছাইয়া বসিয়া ছিল । রমেশ যদি বেশ সহজে তাহার মধ্যে প্রবেশ করিত তবে সুখেরই হইত। কিন্তু তাহাকে ডাকিয়া আনিয়া সমস্ত ছারখার ঔদাসীন্য, এ-সমস্তই মনের তলদেশে আলোড়িত হইয়া উঠিল। কাছে পাইলেই যে পাওয়া হইল, ডাকিয়া আনিলেই যে আসা হইল, তাহা নহে— আসল জিনিসটি যে কী তাহা গাজিপুরে আসার পরে কমলা অতি অল্প দিনেই যেন স্পষ্ট বুঝিতে পারিয়াছে। কিন্তু শৈলর পক্ষে এ-সব কথা বোঝা শক্ত । কমলা এবং রমেশের মাঝখানে যে কোনোপ্রকারের সত্যকার ব্যবধান থাকিতে পারে তাহা সে কল্পনাও করিতে পারে না । সে বহুযত্নে কমলার মাথা নিজের কোলের উপর তুলিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “আচ্ছা ভাই, রমেশবাবুকি তোমাকে কোনো কঠিন কথা বলিয়াছেন ? হয়তো ইনি তঁহাকে ডাকিতে গিয়াছিলেন বলিয়া তিনি রাগ করিয়াছেন। তুমি বলিলে না কেন যে, এ-সমস্ত আমার কাজ ।” কমলা কহিল, “না না, তিনি কিছুই বলেন নাই। কিন্তু কেন তুমি তীহাকে ডাকিয়া আনিলে ?” শৈল ক্ষুব্ধ হইয়া বলিল, “আচ্ছা ভাই, দোষ হইয়াছে, মাপ করো।” কমলা তাড়াতাড়ি উঠিয়া বসিয়া শৈলর গলা জড়াইয়া ধরিল ; কহিল, “যাও ভাই, যাও তুমি, বিপিনবাবু রাগ করিতেছেন।” বাহিরে নির্জন ঘরে রমেশ ‘পায়োনিয়র-এর উপর অনেকক্ষণ বৃথা চোখ বুলাইয়া এক সময় সবলে সেটা ষ্টুড়িয়া ফেলিয়া দিল। তার পর উঠিয়া বসিয়া কহিল, "না, আর না। কালই কলিকাতায় গিয়া প্রস্তুত হইয়া আসিব । কমলাকে আমার স্ত্রী বলিয়া গ্ৰহণ করিতে যতদিন বিলম্ব হইতেছে ততই আমার অন্যায় বাড়িতেছে।” দেশের কবিরুদ্ধ হঠাৎ আজ পূর্ণভাবে জাগ্ৰত ইয়া সমস্ত দ্বন্ধ সঙ্গে একত্বে অতিক্রম রল | ・