গোরা p 8SV) সম্বন্ধে যা ব্যবস্থা করছি তা কুব্যবস্থা হয়ে উঠছে। দেশকে ভালো না বাসলে তাকে ভালো করে জানিবার ধৈর্য থাকে না, তাকে না জানলে তার ভালো করতে চাইলেও তার ভালো করা যায় না । সুচরিতা একটু একটু করিয়া খোচা দিয়া দিয়া গোরার সম্বন্ধে আলোচনাকে নিবিতে দিল না। বিনয়ও গোরার পক্ষে তাহার যাহা-কিছু বলিবার তাহা খুব ভালো করিয়াই বলিতে লাগিল। এমন যুক্তির কথা এমন দৃষ্টান্ত দিয়া এমন গুছাইয়া আর কখনো যেন সে বলে নাই ; গোরাও তাহার নিজের মত এমন পরিষ্কার করিয়া এমন উজ্জ্বল করিয়া বলিতে পারিত কি না সন্দেহ ; বিনয়ের বুদ্ধি ও : প্রকাশক্ষমতার এই অপূর্ব উত্তেজনায় তাহার মনে একটা আনন্দ জন্মিতে লাগিল এবং সেই আনন্দে তাহার মুখ উদ্দীপ্ত হইয়া উঠিল। বিনয় কহিল, “দেখুন, শাস্ত্রে বলে, আত্মানং বিদ্ধি— আপনাকে জানাে। নইলে মুক্তি কিছুতেই নেই। আমি আপনাকে বলছি, আমার বন্ধু গোরা ভারতবর্ষের সেই আত্মবোধের প্রকাশ রূপে আবির্ভূত হয়েছে। তাকে আমি সামান্য লোক বলে মনে করতে পারি নে। আমাদের সকলের মন যখন তুচ্ছ আকর্ষণ নূতনের প্রলোভনে বাহিরের দিকে ছড়িয়ে পড়েছে তখন ঐ একটিমাত্র লোক এই-সমস্ত বিক্ষিপ্ততার মাঝখানে অটলভাবে দাড়িয়ে সিংহগর্জনে সেই পুরাতন মন্ত্র বলছে— আত্মানং বিদ্ধি ।” এই আলোচনা আরো অনেকক্ষণ চলিতে পারিত— সুচরিতাও ব্যগ্ৰ হইয়া শুনিতেছিল- কিন্তু হঠাৎ পাশের একটা ঘর হইতে সতীশ চীৎকার করিয়া আবৃত্তি আরম্ভ করিল “বোলো না কাতর স্বরে না করি বিচার জীবন স্বপনসম মায়ার সংসার ।” বেচারা সতীশ বাড়ির অতিথি-অভ্যাগতদের সামনে বিদ্যা ফলাইবার কোনো অবকাশ পায় না । লীলা পর্যন্ত ইংরেজি কবিতা আওড়াইয়া সভা গরম করিয়া তোলে, কিন্তু সতীশকে বরদাসুন্দরী ডাকেন না। অথচ লীলার সঙ্গে সকল বিষয়েই সতীশের খুব একটা প্রতিযোগিতা আছে। কোনোমতে লীলার দৰ্প চূর্ণ করা সতীশের জীবনের প্রধান সুখ । বিনয়ের সম্মুখে কােল লীলার পরীক্ষা হইয়া গেছে। তখন অনাহুত সতীশ তাহাকে ছাড়াইয়া উঠিবার কোনো চেষ্টা করিতে পারে নাই। চেষ্টা করিলেও বরদাসুন্দরী তখনই তাহাকে দাবাইয়া দিতেন ; তাই সে আজ পাশের ঘরে যেন আপন মনে উচ্চস্বরে কাব্যচর্চায় প্রবৃত্ত হইল। শুনিয়া সুচরিতা হাস্যসংবরণ করিতে পারিল না। এমন সময় লীলা তাহার মুক্ত বেণী দোলাইয়া ঘরে ঢুকিয়া সুচরিতার গলা জড়াইয়া ধরিয়া তাহার কানে কানে কী একটা বলিল। অমনি সতীশ ছুটিয়া তাহার পিছনে আসিয়া কহিল, “আচ্ছা লীলা, বলো দেখি “মনোযোগ মানে কী ?” लैीला कश्लि, "दलद ना |” সতীশ । ইস ! বলব না ! জান না। তাই বলো-না । বিনয় সতীশকে কাছে টানিয়া লইয়া হাসিয়া কহিল, “তুমি বলে দেখি মনোযোগ মানে কী ?” সতীশ সগর্বে মাথা তুলিয়া কহিল, “মনোযোগ মানে মনোনিবেশ ।” সুচরিতা জিজ্ঞাসা করিল, “মনোনিবেশ বলতে কী বোঝায় ?” আত্মীয় না হইলে আত্মীয়কে এমন বিপদে কে ফেলিতে পারে ? সতীশ প্রশ্নটা যেন শুনিতে পায় নাই এমনি ভাবে লাফাইতে লাফাইতে ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল । বিনয় আজ পরেশবাবুর বাড়ি হইতে সকাল সকাল বিদায় লইয়া গোরার কাছে যাইবে নিশ্চয় স্থির করিয়া আসিয়াছিল । বিশেষত গোরার কথা বলিতে বলিতে গোরার কাছে যাইবার উৎসাহও তাহার সুপ্রিল ইয়া উঠিল। তাই সে বড়িতে চারটি বজিতে শুনিয়া তাড়াতাড়িডু চৌকি ছাড়িয়া উঠিয়া সুচরিতা কহিল, “আপনি এখনই যাবেন ? মা আপনার জন্য খাবার তৈরি করছেন ; আর-একটু পরে গেলে চলবে না ?” বিনয়ের পক্ষে এ তো প্রশ্ন নয়, এ হুকুম । সে তখনই বসিয়া পড়িল। লাবণ্য রঙিন রেশমের
পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৫৯
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।
![](http://upload.wikimedia.org/wikisource/bn/thumb/f/f5/%E0%A6%B0%E0%A6%AC%E0%A7%80%E0%A6%A8%E0%A7%8D%E0%A6%A6%E0%A7%8D%E0%A6%B0-%E0%A6%B0%E0%A6%9A%E0%A6%A8%E0%A6%BE%E0%A6%AC%E0%A6%B2%E0%A7%80_%28%E0%A6%A4%E0%A7%83%E0%A6%A4%E0%A7%80%E0%A6%AF%E0%A6%BC_%E0%A6%96%E0%A6%A3%E0%A7%8D%E0%A6%A1%29_-_%E0%A6%B8%E0%A7%81%E0%A6%B2%E0%A6%AD_%E0%A6%AC%E0%A6%BF%E0%A6%B6%E0%A7%8D%E0%A6%AC%E0%A6%AD%E0%A6%BE%E0%A6%B0%E0%A6%A4%E0%A7%80.pdf/page459-1024px-%E0%A6%B0%E0%A6%AC%E0%A7%80%E0%A6%A8%E0%A7%8D%E0%A6%A6%E0%A7%8D%E0%A6%B0-%E0%A6%B0%E0%A6%9A%E0%A6%A8%E0%A6%BE%E0%A6%AC%E0%A6%B2%E0%A7%80_%28%E0%A6%A4%E0%A7%83%E0%A6%A4%E0%A7%80%E0%A6%AF%E0%A6%BC_%E0%A6%96%E0%A6%A3%E0%A7%8D%E0%A6%A1%29_-_%E0%A6%B8%E0%A7%81%E0%A6%B2%E0%A6%AD_%E0%A6%AC%E0%A6%BF%E0%A6%B6%E0%A7%8D%E0%A6%AC%E0%A6%AD%E0%A6%BE%E0%A6%B0%E0%A6%A4%E0%A7%80.pdf.jpg)