পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৭৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গোরা 88S ডরাই। তুমি নিজের মুখে একবার বিনয়কে অনুরোধ করো, আমি আর কিছু চাই নে— তাতে যদি ফল না হয় তো না হবে ।” গোরা কহিল, “আচ্ছা ।” ভূক্ত মেন কহিল, এইবার মােরর কােন সদেশ এবং গলের কােন ইস্টর ফরমাণ দিতে পারি ” গোরা অবসরক্রমে বিনয়কে কহিল, “শশিমুখীর সঙ্গে তোমার বিবাহের জন্য দাদা ভারি পীড়াপীড়ি আরম্ভ করেছেন। এখন তুমি কী বল ?” বিনয় । আগে তোমার কী ইচ্ছা সেইটে বলো । গোরা । আমি তো বলি মন্দ কী ! আগে তাে বৃদ্ধি কের বলতে আলী আিছল কষ্ট ধরে করুন। এ তে একক কি হয়েই গোরা। এখন ঠিক করা গেল তুমি বিয়ে করবে। আর আমি করব না। বিনয় । কেন, এক যাত্রায় পৃথক ফল কেন ? গোরা। পৃথক ফল হবার ভয়েই এই ব্যবস্থা করা যাচ্ছে। বিধাতা কোনো কোনো মানুষকে সহজেই বেশি ভারগ্রস্ত করে গড়ে থাকেন, কেউ বা সহজেই দিব্য ভারহীন— এই উভয় জীবকে একত্রে জুড়ে চালাতে গেলে এদের একটির উপর বাইরে থেকে বোঝা চাপিয়ে দুজনের ওজন সমান করে নিতে হয়। তুমি বিবাহ করে একটু দায়গ্ৰস্ত হলে পর তোমাতে আমাতে সমান চালে চলতে পারব। বিনয় একটু হাসিল এবং কহিল, “যদি সেই মতলব হয় তবে এই দিকেই বাটখারাটি চাপাও।” গোরা । বাটখারাটি সম্বন্ধে আপত্তি নেই তো ? বিনয় । ওজন সমান করবার জন্যে যা হাতের কাছে আসে তাতেই কাজ চালানো যেতে পারে । ও পাথর হলেও হয়, ঢেলা হলেও হয়, যা খুশি । গোরা যে বিবাহ-প্ৰস্তাবে কেন উৎসাহ প্ৰকাশ করিল তাহা বিনয়ের বুঝিতে বাকি রহিল না | পাছে বিনয় পরেশবাবুর পরিবারের মধ্যে বিবাহ করিয়া বসে গোরার মনে এই সন্দেহ হইয়াছে অনুমান করিয়া বিনয় মনে মনে হাসিল | এরূপ বিবাহের সংকল্প ও সম্ভাবনা তাহার মনে এক মুহুর্তের জন্যও উদিত হয় নাই। এ যে হইতেই পারে না। যাই হােক, শশিমুখীকে বিবাহ করিলে এরূপ অদ্ভুত আশঙ্কার একেবারে মূল উৎপাটিত হইয়া যাইবে এবং তাহা হইলেই উভয়ের বন্ধুত্বসম্বন্ধ পুনরায় সুস্থ ও শান্ত হইবে ও পরেশবাবুদের সঙ্গে মেলামেশা করিতেও তাহার কোনো দিক হইতে কোনো সংকোচের কারণ থাকিবে না, এই কথা চিন্তা করিয়া সে শশিমুখীর সহিত বিবাহে সহজেই সম্মতি দিল। মধ্যাহ্নে আহারান্তে রাত্রের নিদ্রার ঋণশোধ করিতে দিন কাটিয়া গেল। সেদিন দুই বন্ধুর মধ্যে আর কোনো কথা হইল না, কেবল জগতের উপর সন্ধ্যার অন্ধকার পর্দা পড়িলে প্রণয়ীদের মধ্যে যখন মনের পর্দা উঠিয়া যায়। সেই সময় বিনয় ছাতের উপর বসিয়া সিধা আকাশের দিকে তাকাইয়া বলিল, “দেখো, গোরা, একটা কথা আমি তোমাকে বলতে চাই । আমার মনে হয়। আমাদের স্বদেশপ্রেমের মধ্যে একটা গুরুতর অসম্পূর্ণতা আছে। আমরা ভারতবর্ষকে আধখানা করে দেখি ।” গোরা । কেন বলে দেখি ? বিনয় । আমরা ভারতবর্ষকে কেবল পুরুষের দেশ বলেই দেখি, মেয়েদের একেবারেই দেখি নে । গোরা । তুমি ইংরেজদের মতো মেয়েদের বুঝি ঘরে বাইরে, জলে স্থলে শূন্যে, আহারে আমোদে কর্মে, সর্বত্রই দেখতে চাও ? তাতে ফল হবে এই যে, পুরুষের চেয়ে মেয়েকেই বেশি করে দেখতে থাকবে- তাতেও দৃষ্টির সামঞ্জস্য নষ্ট হবে। বিনয়। না না, তুমি আমার কথাটাকে ওরকম করে উড়িয়ে দিলে চলবে না। ইংরেজদের মতো করে দেখব কি না-দেখব। সে কথা কেন তুলছ! আমি বলছি। এটা সত্য যে, স্বদেশের মধ্যে মেয়েদের অংশকে আমাদের চিন্তার মধ্যে আমরা যথা পরিমাণে আনি নে | তোমার কথাই আমি বলতে পারি,