পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫০০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8V8 রবীন্দ্র-রচনাবলী একতলার বসিবার ঘর ছাড়িয়া প্রায় ছুটিয়া বাহির হইল। সেই সময় কৃষ্ণদয়াল গঙ্গামান সারিয়া ঘটিতে গঙ্গাজল লইয়া নামাবলী গায়ে দিয়া মনে মনে মন্ত্র জপ করিতে করিতে ঘরে চলিয়াছিলেন। গোরা একেবারে তাহার ঘাড়ের উপর গিয়া পড়িল। লজ্জিত হইয়া গোরা তাড়াতাড়ি তাহার পা ছুইয়া প্ৰণাম করিল। তিনি শশব্যস্ত হইয়া “থাক থাক বলিয়া সসংকোচে চলিয়া গেলেন। পূজায় বসিবার পূর্বে গোরার স্পর্শে র্তাহার গঙ্গামানের ফল মাটি হইল। কৃষ্ণদয়াল যে গোরার সংস্পৰ্শই বিশেষ করিয়া এড়াইয়া চলিবার চেষ্টা করিতেন গোরা তাহা ঠিক বুঝিত না ; সে মনে করিত শুচিবায়ুগ্ৰস্ত বলিয়া সর্বপ্রকারে সকলেরই সংস্রব বঁাচাইয়া চলাই অহরহ তাহার সতর্কতার একমাত্র লক্ষ্য ছিল ; আনন্দময়ীকে তো তিনি স্লেচ্ছ বলিয়া দূরে পরিহার করিতেন- মহিম কাজের লোক, মহিমের সঙ্গে তাহার দেখা সাক্ষাতেরই অবকাশ ঘটিত না । সমস্ত পরিবারের মধ্যে কেবল মহিমের কন্যা শশিমুখীকে তিনি কাছে লইয়া তাহাকে সংস্কৃত স্তোত্র মুখস্ত করাইতেন এবং পূজাৰ্চনাবিধিতে দীক্ষিত করিতেন। কৃষ্ণদয়াল গোরােকর্তৃক তাহার পাদস্পর্শে ব্যস্ত হইয়া পলায়ন করিলে পর তাহার সংকোচের কারণ সম্বন্ধে গোরার চেতনা হইল এবং সে মনে মনে হাসিল । এইরূপে পিতার সহিত গোরার সমস্ত সম্বন্ধ প্ৰায় বিচ্ছিন্ন হইয়া গিয়াছিল এবং মাতার অনাচারকে সে যতই নিন্দ করুক এই আচারদ্রোহিনী মাকেই গোরা তাহার জীবনের সমস্ত ভক্তি সমর্পণ করিয়া পূজা করিত। আহারান্তে গোরা একটি ছোটাে পুঁটলিতে গোটকয়েক কাপড় লইয়া সেটা বিলাতি পর্যটকদের মতো পিঠে বাধিয়া মার কাছে আসিয়া উপস্থিত হইল। কহিল, “মা, আমি কিছুদিনের মতো বেরোবি।” আনন্দময়ী কহিলেন, “কোথায় যাবে বাবা ?” গোরা কহিল, “সেটা আমি ঠিক বলতে পারছি নে ৷” আনন্দময়ী জিজ্ঞাসা করিলেন, “কোনো কাজ আছে ?” গোরা কহিল, “কাজ বলতে যা বোঝায় সেরকম কিছু নয়- এই যাওয়াটাই একটা কাজ ।” আনন্দময়ীকে একটুখানি চুপ করিয়া থাকিতে দেখিয়া গোরা কহিল, “মা, দোহাই তোমার, আমাকে বারণ করতে পারবে না। তুমি তো আমাকে জােনই, আমি সন্ন্যাসী হয়ে যাব এমন ভয় নেই। আমি । মাকে ছেড়ে বেশি দিন কোথাও থাকতে পারি নে।” মারি প্রতি তাহার ভালোবাসা গোরা কোনোদিন মুখে এমন করিয়া বলে নাই— তাই আজ কথাটা বলিয়াই সে লজ্জিত হইল । পুলকিত আনন্দময়ী তাড়াতাড়ি তাহার লজ্জােটা চাপা দিয়া কহিলেন, “বিনয় সঙ্গে যাবে বুঝি ?” গোরা ব্যস্ত হইয়া কহিল, “না। মা, বিনয় যাবে না। ঐ দেখো, অমনি মা’র মনে ভাবনা হচ্ছে, বিনয় না গেলে তার গোরাকে পথে ঘাটে রক্ষা করবে কে ? বিনয়কে যদি তুমি আমার রক্ষক মনে কর সেটা তোমার একটা কুসংস্কার- এবার নিরাপদে ফিরে এলে ঐ সংস্কারটা তোমার ঘুচাবে।” আনন্দময়ী জিজ্ঞাসা করিলেন, “মাঝে মাঝে খবর পাব তো ?” গোরা কহিল, “খবর পাবে না বলেই ঠিক করে রাখো— তার পরে যদি পাও তো খুশি হবে । ভয় কিছুই নেই ; তোমার গোরাকে কেউ নেবে না। মা, তুমি আমার যতটা মূল্য কল্পনা কর আর-কেউ ততটা করে না । তবে এই বেঁচেকাটির উপর যদি কারও লোভ হয় তবে এটি তাকে দান করে দিয়ে চলে আসব ; এটা রক্ষা করতে গিয়ে প্ৰাণ দান করব না- সে নিশ্চয় ।” - গোরা আনন্দময়ীর পায়ের ধূলা লইয়া প্ৰণাম করিল, তিনি তাহার মাথায় হাত বুলাইয়া হাত চুম্বন করিলেন, কোনোপ্রকার নিষেধমাত্র করিলেন না। নিজের কষ্ট হইবে বলিয়া অথবা কল্পনায় অনিষ্ট । আশঙ্কা করিয়া আনন্দময়ী কখনো কাহাকেও নিষেধ করিতেন না । নিজের জীবনে তিনি অনেক বাধাবিপদের মধ্য দিয়া আসিয়াছেন, বাহিরের পৃথিবী তাহার কাছে অপরিচিত নহে; তাহার মনে ভয় বলিয়া কিছু ছিল না। গোরা যে কোনো বিপদে পড়িবে সে ভয় তিনি মনে আনেন নাই- কিন্তু গােরার মনের মধ্যে যে কী একটা বিপ্লব ঘটিয়াছে সেই কথাই তিনি কাল হইতে ভাবিতেছেন। আজ হঠাৎ গোরা অকারণে ভ্ৰমণ করিতে চলিল শুনিয়া তাহার সেই ভাবনা আরো বাড়িয়া উঠিয়াছে।