পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৭০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

(SV রবীন্দ্র-রচনাবলী হারানবাবু কহিলেন, “সুচরিতা তো এখানেই রয়েছেন। আপনি ওঁকেই জিজ্ঞাসা করুন-না। শুনতে পাই উনি সকলের ছোওয়া খান না । সে কথা কি মিথ্যা ?” সুচরিতা দোয়াতদানের প্রতি অনাবশ্যক মনােযোগ দূর করিয়া কহিল, “বাবা জানেন আমি সকলের ছোওয়া খাই নে। উনি যদি আমার এই আচরণ সহ্য করে থাকেন তা হলেই হল । আপনাদের যদি ভালো না লাগে আপনারা যত খুশি আমার নিন্দা করুন, কিন্তু বাবাকে বিরক্ত করছেন কেন ? উনি আপনাদের কত ক্ষমা করে চলেন তা আপনারা জানেন ? এ কি তারই প্রতিফল ?” হারানবাবু আশ্চর্য হইয়া ভাবিতে লাগিলেন— সুচরিতাও আজকাল কথা কহিতে শিখিয়ছে। পরেশবাবু শান্তিপ্রিয় লোক ; তিনি নিজের বা পরের সম্বন্ধে অধিক আলোচনা ভালোবাসেন না। এপর্যন্ত ব্ৰাহ্মসমাজে তিনি কোনো কাজে কোনো প্রধান পদ গ্রহণ করেন নাই ; নিজেকে কাহারও লক্ষগোচর না করিয়া নিভৃতে জীবন যাপন করিয়াছেন । হারানবাবু পরেশের এই ভাবকেই উৎসাহহীনতা ও ঔদাসীন্য বলিয়া গণ্য করিতেন, এমন-কি, পরেশবাবুকে তিনি ইহা লইয়া ভৎসনাও করিয়াছেন । ইহার উত্তরে পরেশবাবু বলিয়াছিলেন— ‘ঈশ্বর, সচল এবং অচল। এই দুই শ্রেণীর পদার্থই সৃষ্টি করিয়াছেন। আমি নিতান্তই অচল । আমার মতো লোকের দ্বারা যে কাজ পাওয়া সম্ভব। ঈশ্বর তাহা আদায় করিয়া লইবেন । যাহা সম্ভব নহে, তাহার জন্য চঞ্চল হইয়া কোনো লাভ নাই । আমার বয়স যথেষ্ট হইয়াছে ; আমার কী শক্তি আছে আর কী নাই তাহার মীমাংসা হইয়া গিয়াছে। এখন আমাকে ঠেলা ঠেলি করিয়া কোনো ফল পাওয়া যাইবে না ।” হারানবাবুর ধারণা ছিল তিনি অসাড় হৃদয়েও উৎসাহ সঞ্চার করিতে পারেন ; জড়চিত্তকে কর্তব্যের পথে ঠেলিয়া দেওয়া এবং স্থলিত জীবনকে অনুতাপে বিগলিত করা তাহার একটা স্বাভাবিক ক্ষমতা | তাহার অত্যন্ত বলিষ্ঠ এবং একাগ্ৰ শুভ ইচ্ছাকে কেহই অধিক দিন প্রতিরোধ করিতে পারে না এইরূপ তাহার বিশ্বাস । তাহার সমাজের লোকের ব্যক্তিগত চরিত্রে যে-সকল ভালো পরিবর্তন ঘটিয়াছে তিনি নিজেকেই কোনো-না-কোনো প্রকারে তাহার প্রধান কারণ বলিয়া নিশ্চয় স্থির করিয়াছেন । তাহার অলক্ষ্য প্রভাবও যে ভিতরে ভিতরে কাজ করে ইহাতে তাহার সন্দেহ নাই। এ পর্যন্ত সুচরিতাকে যখনই তাহার সম্মুখে কেহ বিশেষরূপে প্রশংসা করিয়াছে তিনি এমন ভােব ধারণ করিয়াছেন যেন সে প্রশংসা সম্পূর্ণই তাহার। তিনি উপদেশ দৃষ্টান্ত এবং সঙ্গীতেজের দ্বারা সুচরিতার চরিত্রকে এমন করিয়া গড়িয়া তুলিতেছেন যে এই সুচরিতার জীবনের দ্বারাই লোকসমাজে তাহার আশ্চর্য প্রভাব প্রমাণিত হইবে এইরূপ তাহার আশা ছিল । সেই সুচরিতার শোচনীয় পতনে নিজের ক্ষমতা সম্বন্ধে তাহার গর্ব কিছুমাত্র হ্রাস হইল না, তিনি সমস্ত দোষ চাপাইলেন। পরেশবাবুর স্কন্ধে | পরেশবাবুকে লোকে বরাবর প্রশংসা করিয়া আসিয়াছে, কিন্তু হারানবাবু কখনাে তাহাতে যোগ দেন নাই ; ইহাতেও তাহার কতদূর প্রজ্ঞতা প্রকাশ পাইয়াছে তাহা এইবার সকলে বুঝিতে পরিবে এইরূপ তিনি আশা করিতেছেন। হারানবাবুর মতো লোক আর-সকলই সহ্য করিতে পারেন, কিন্তু যাহাদিগকে বিশেষরূপে হিতপথে চালাইতে চেষ্টা করেন তাহারা যদি নিজের বুদ্ধি অনুসারে স্বতন্ত্র পথ অবলম্বন করে তবে সে অপরাধ তিনি কোনোমতেই ক্ষমা করিতে পারেন না । সহজে তাহাদিগকে ছাড়িয়া দেওয়া তাহার পক্ষে অসাধ্য ; যতই দেখেন তাহার উপদেশে ফল হইতেছে না ততই তাহার জেদ বাড়িয়া যাইতে থাকে ; তিনি ফিরিয়া ফিরিয়া বারংবার আক্রমণ করিতে থাকেন। কল যেমন দম না ফুরাইলে থামিতে পারে না। তিনিও তেমনি কোনোমতেই নিজেকে সংবরণ করিতে পারেন না ; বিমুখ কর্ণের কাছে এক কথা সহস্ৰ বার আবৃত্তি করিয়াও হার মানিতে চাহেন না । । ইহাতে সুচরিতা বড়ো কষ্ট পাইতে লাগিল— নিজের জন্য নহে, পরেশবাবুর জন্য। পরেশবাবু যে ব্ৰাহ্মসমাজের সকলের সমালোচনার বিষয় হইয়া উঠিয়াছেন এই অশান্তি নিবারণ করা যাইবে কী উপায়ে ? অপর পক্ষে সুচরিতার মাসিও প্রতিদিন বুঝিতে পারিতেছিলেন যে, তিনি একান্ত নম্র হইয়া নিজেকে যতই আড়ালে রাখিবার চেষ্টা করিতেছেন ততই এই পরিবারের পক্ষে উপদ্রব্যস্বরূপ হইয়া