পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬০৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গোরা (VG কতকগুলা বলিয়া চলিয়া গেলেন। তিনি বুঝাইয়া গেলেন, বিনয়কে এইরূপ ফাঁদে ফেলিয়া সর্বনাশ করিবার জন্যই পরেশবাবুর ঘরে একটা নির্লজ্জ আয়োজন চলিতেছিল, বিনয় নির্বোিধ বলিয়াই এমন ধ্ৰুপদে সে আটকা পড়িয়াছে, ভোলাক দেখি ওরা গােরাকে, তবে তো বুঝি। সে বড়ো শক্ত জায়গা। বিনয় চারিদিকেই এইরূপ লাঞ্ছনার মূর্তি দেখিয়া স্তব্ধ হইয়া বসিয়া রহিল। আনন্দময়ী কহিলেন, বিনয় মুখ তুলিয়া তীহার মুখের দিকে চাহিল। আনন্দময়ী কহিলেন, “তোর উচিত একবার গৱেশবাবুর কাছে যাওয়া । তীর সঙ্গে কথা হলেই সমস্ত পরিষ্কার হয়ে যাবে।” (S সুচরিত হঠাৎ আনন্দময়ীকে দেখিয়া আশ্চর্য হইয়া কহিল, “আমি যে এখনই আপনার ওখানে যাব বলে প্রস্তুত হচ্ছিলুম।” । আনন্দময়ী হাসিয়া কহিলেন, “তুমি যে প্রস্তুত হচ্ছিলে তা আমি জানতুম না, কিন্তু যেজন্যে প্রস্তুত হচ্ছিলে সেই খবরটা পেয়ে আমি থাকতে পারলুম না, চলে এলুম।” আনন্দময়ী খবর পাইয়াছেন শুনিয়া সুচরিতা আশ্চর্য হইয়া গেল ! আনন্দময়ী কহিলেন, “মা, বিনয়কে আমি আমার আপনি ছেলের মতোই জানি। সেই বিনয়ের সম্পর্ক থেকেই তোমাদের যখন নাও জেনেছি তখনই তোমাদের মনে মনে কত আশীর্বাদ করেছি। তোমাদের প্রতি কোনো অন্যায় হচ্ছে। এ কথা শুনে আমি স্থির থাকতে পারি। কই ? আমার দ্বারা তোমাদের কোনো উপকার হতে পারবে কি না তা তো জানি নে— কিন্তু মনটা কেমন করে উঠল, তাই তোমাদের কাছে ছুটে এলুম। মা, বিনয়ের তরফে কি কোনো অন্যায় ঘটেছে ?” সুচরিতা কহিল, “কিছুমাত্র না । যে কথাটা নিয়ে খুব বেশি আন্দােলন হচ্ছে ললিতাই তার জন্যে দায়ী। ললিতা যে হঠাৎ কাউকে কিছু না বলে স্টীমারে চলে যাবে বিনয়বাবু তা কখনো কল্পনাও করেন নি। লোকে এমনভাবে কথা কচ্ছে যেন ওদের দুজনের মধ্যে গোপনে পরামর্শ হয়ে গিয়েছিল। আবার ললিতা এমনি তেজস্বিনী মেয়ে, সে যে প্রতিবাদ করবে কিংবা কোনােরকমে বুঝিয়ে বলবে আসল ঘটনােটা কী ঘটেছিল, সে তার দ্বারা কোনোমতেই হবার জো নেই।” আনন্দময়ী কহিলে, “এর তো একটা উপায় করতে হচ্ছে। এই-সব কথা শুনে অবধি বিনয়ের মনে তো কিছুমাত্র শান্তি নেই— সে তো নিজেকেই অপরাধী বলে ঠাউরে বসে আছে।” সুদৃঢ় স্থার অবস্থির দু এশখন কি তাঁর বািল অঙ্ক আপদ , হম কল্প য়বাব ।” আনন্দময়ী সংকোচপীড়িত সুচরিতাকে তাহার কথা শেষ করিতে না দিয়া কহিলেন, “দেখো বাছা, আমি তোমাকে বলছি ললিতার জনো বিনয়কে যা করতে বলবে সে তাই করবে। বিনয়কে ছেলেবেলা থেকে দেখে আসছি। ও যদি একবার আত্মসমর্পণ করল, তবে ও আর কিছু হাতে রাখতে পারে না | সেইজনো আমাকে বড়ো ভয়ে ভয়েই থাকতে হয়, ওর পাছে এমন জায়গায় মন যায় যেখানে থেকে ওর কিছু ফিরে পাবার কোনো আশা নেই।” সুচরিতার মন হইতে একটা বোঝা নামিয়া গেল । সে কহিল, "ললিতার সন্মতির জন্যে আপনাকে কিছুই ভাবতে হবে না, আমি তার মন জানি। কিন্তু বিনয়বাবু কি তীর সমাজ পরিত্যাগ করতে রাজি হবেন ?” আনন্দময়ী কহিলেন, “সমাজ হয়তো তাকে পরিত্যাগ করতে পারে, কিন্তু সে আগেভাগে গায়ে পড়ে সমাজ পরিত্যাগ করতে যাবে কেন মা ? তার কি কোনাে প্রয়ােজন আছে ?” সুচরিতা কহিল, "বলেন কী মা ? বিনয়বাবু হিন্দুসমাজে থেকে ব্রাহ্মঘরের মেয়ে বিয়ে করবেন ?” আনন্দময়ী কহিলেন, “সে যদি করতে রাজি হয় তাতে তোমাদের আপত্তি কী ?”