পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৪৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

V9OJ রবীন্দ্র-রচনাবলী ললিতা কথাটা ভালো বুঝিতে পারিল না, কারণ অন্য সমাজের প্রথার সহিত তাহাদের সমাজের প্ৰভেদ সে কোনোদিন প্রত্যক্ষ করে নাই। তাহার ধারণা ছিল মোটের উপর আচার-অনুষ্ঠানে পরস্পরে খুব বেশি পার্থক্য নাই। বিনয়ের সঙ্গে তাঁহাদেব অনৈক্য যেমন অনুভবগোচর নয়, সমাজে সমাজেও যেন সেইরূপ । বস্তুত হিন্দুবিবাহ-অনুষ্ঠানের মধ্যে তাহার পক্ষে যে বিশেষ কোনো বাধা আছে তাহা সে জানিতই না । বিনয় কহিল, “শালগ্ৰাম রেখে আমাদের বিবাহ হয়, আপনি সেই কথা বলছেন ?” পরেশবাবু ললিতার দিকে একবার চাহিয়া কহিলেন, “হা, ললিতা কি সেটা স্বীকার করতে পারবে ?" বিনয় ললিতার মুখের দিকে চাহিয়া দেখিল । বুঝিতে পারিল, ললিতার সমস্ত অন্তঃকরণ সংকুচিত হইয়া উঠিয়াছে। ললিত হৃদয়ের আবেগে এমন একটি স্থানে আসিয়া পড়িয়াছে যাহা তাহার পক্ষে সম্পূর্ণ অপরিচিত ও সংকটময় । ইহাতে বিনয়ের মনে অত্যন্ত একটি করুণা উপস্থিত হইল । সমস্ত আঘাত নিজের উপর লইয়া ইহাকে বাচাইতে হইবে। এতবড়ো তেজ পরাভূত হইয়া ফিরিয়া যাইবে সেও যেমন অসহ্য, জয়ী হইবার দুর্দম উৎসাহে এ যে মৃত্যুবাণ বুক পাতিয়া লইবে সেও তেমনি নিদারুণ । ইহাকে জয়ীও করিতে হইবে, ইহাকে রক্ষাও করিতে হইবে । ললিতা মাথা নিচু করিয়া কিছুক্ষণ বসিয়া রহিল। তাহার পর একবার মুখ তুলিয়া করুণাচক্ষে বিনয়ের দিকে চাহিয়া কহিল, “আপনি কি সত্য-সত্য মনের সঙ্গে শালগ্ৰাম মানেন ?” বিনয় তৎক্ষণাৎ কহিল, “না, মানি নে ৷ শালগ্রাম আমার পক্ষে দেবতা নয়, আমার পক্ষে একটি সামাজিক চিহ্নমাত্ৰ ।” ললিত কহিল, “মনে মনে যাকে চিহ্ন বলে জানেন, বাইরে তাকে তো দেবতা বলে স্বীকার করতে হয় ?” বিনয় পরেশের দিকে চাহিয়া কহিল, “শালগ্ৰাম আমি রাখব না।” পরেশ চৌকি ছাডিয়া উঠিয়া কহিলেন, “বিনয়, তোমরা সব কথা পরিষ্কার করে চিন্তা করে দেখছি না | তোমার একলার বা আর-কারও মতামত নিয়ে কথা হচ্ছে না । বিবাহ তো কেবল ব্যক্তিগত নয়, এটা একটা সামাজিক কাৰ্য, সে কথা ভুললে চলবে কেন ? তোমরা কিছুদিন সময় নিয়ে ভেবে দেখে, এখনই মত স্থির করে ফেলো না ।” গুলির পরেশ ও ছািডয়া বাগান বারি হয় গেলেন এবং সেখােন একলা পাচার করে গলেন । g ললিতাও ঘর হইতে বাহির হইবার উপক্ৰম করিয়া একটু থামিল এবং বিনয়ের দিকে পশ্চাৎ করিয়া কহিল, “আমাদের ইচ্ছা যদি অন্যায় ইচ্ছা না হয় এবং সে ইচ্ছা যদি কোনো-একটা সমাজের বিধানের সঙ্গে আগাগোড়া না মিলে যায় তা হলেই আমাদের মাথা হেঁট করে ফিরে যেতে হবে এ আমি কোনোমতেই বুঝতে পারি নে। সমাজে মিথ্যা ব্যবহারের স্থান আছে আর স্থান নেই ন্যায়সংগত আচরণের ?” বিনয় ধীরে ধীরে ললিতার কাছে আসিয়া দাড়াইয়া কহিল, “আমি কোনো সমাজকেই ভয় করি নে, আমরা দুজনে মিলে যদি সত্যকে আশ্রয় করি তা হলে আমাদের সমাজের তুল্য এতবড়ো সমাজ আর কোথায় পাওয়া যাবে ?” বরদাসুন্দরী ঝড়ের মতো তাঁহাদের দুইজনার সম্মুখে আসিয়া কহিলেন, “বিনয়, শুনলুম নাকি তুমি प्रीका (नत ना ?” বিনয় কহিল, “দীক্ষা আমি উপযুক্ত গুরুর কাছ থেকে নেব, কোনো সমাজের কাছ থেকে নেব। कीं ।” বরদাসুন্দরী অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হইয়া কহিলেন, “তোমাদের এ-সব ষড়যন্ত্র, এ-সব প্রবঞ্চনার মানে কী ?