পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭০১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গোরা wo ছেদন করে তবে আমার নবজীবন জন্মগ্রহণ করবে। কাল প্রাতে জনসমাজের কাছে আমার লৌকিক প্রায়শ্চিত্ত হবে। ঠিক তার পূর্বরাত্রেই আমার জীবনবিধাতা এসে আমার দ্বারে আঘাত করেছেন। অন্তরের মধ্যে আমার অন্তরতম প্ৰায়শ্চিত্ত না হলে কাল আমি শুদ্ধি গ্রহণ করব কেমন করে ! যে দান আমার পক্ষে সকলের চেয়ে কঠিন দান সেই দান আমার দেবতাকে আজ সম্পূর্ণ উৎসর্গ করে দিয়ে তবেই আমি সম্পূর্ণ পবিত্ররূপে নিঃস্ব হতে পারব- তবেই আমি ব্ৰাহ্মণ হব ।” গোরা হরিমোহিনীর সম্মুখে আসিতেই তিনি বলিয়া উঠিলেন, “বাবা, একবার তুমি আমার সঙ্গে চলো । তুমি গেলে, তুমি মু. এর একটি কথা বললেই সব হয়ে যাবে।” গোরা কহিল, “আমি কেন যাব ! তীর সঙ্গে আমার কী যোগ ! কিছুই না।” হরিমোহিনী কহিলেন, “সে যে তোমাকে দেবতার মতো ভক্তি করে- তোমাকে গুরু বলে মানে ৷” গোরার হৃৎপিণ্ডের এক দিক হইতে আর-এক দিকে বিদ্যুৎতপ্ত বজ্ৰসুচী বিধিয়া গেল। গোরা কহিল, “আমার যাবার প্রয়ােজন দেখি নে ! তীর সঙ্গে আমার দেখা হবার আর-কোনো সম্ভাবনা নেই ।” १ হরিমোহিনী খুশি হইয়া কহিলেন, “সে তো বটেই। অতবড়ো মেয়ের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ হওয়াটা তো ভালো নয়। কিন্তু, বাবা, আজকের আমার এই কাজটি না করে দিয়ে তো তুমি ছাড়া পাবে না। তার পরে আর কখনো যদি তোমাকে ডাকি তখন বোলো ৷” গোরা বার বার করিয়া মাথা নাড়িল । আর না, কিছুতে না । শেষ হইয়া গেছে। তাহার বিধাতাকে নিবেদন করা হইয়া গেছে । তাহার শুচিতায় এখন সে আর কোনো চিহ্ন ফেলিতে পরিবে না । সে দেখা করিতে যাইবে না । হরিমোহিনী যখন গোরার ভাবে বুঝিলেন তাহাকে টলানো সম্ভব হইবে না। তখন তিনি কহিলেন, “নিতান্তই যদি না যেতে পাের তবে এক কাজ করো বাবা, একটা চিঠি তাকে লিখে দাও ।” গোরা মাথা নাড়িল । সে হইতেই পারে না । চিঠিপত্র নয় । হরিমোহিনী কহিলেন, “আচ্ছা, তুমি আমাকেই দু-লাইন লিখে দাও । তুমি সব শাস্ত্ৰই জান, আমি তোমার কাছে বিধান নিতে এসেছি ।” গোরা জিজ্ঞাসা করিল, “কিসের বিধান ?” হরিমোহিনী কহিলেন, “হিন্দুঘরের মেয়ের উপযুক্ত বয়সে বিবাহ করে গৃহধর্ম পালন করাই সকলের চেয়ে বড়ো ধর্ম কি না ।” গোরা কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া কহিল, “দেখুন, আপনি এ-সমস্ত ব্যাপারে আমাকে জড়াবেন না । বিধান দেবার পণ্ডিত আমি নই।” হরিমোহিনী তখন একটু তীব্রভাবে কহিলেন, “তোমার মনের ভিতরকার ইচ্ছােটা তা হলে খুলেই বলো-না ! গোড়াতে ফাস জড়িয়েছ তুমিই, এখন খোলবার বেলায় বল “আমাকে জড়াবেন না’ | এর মানেটা কী ? আসল কথা, ইচ্ছেটা তোমার নয় যে ওর মন পরিষ্কার হয়ে যায় ।” অন্য কোনো সময় হইলে গোরা আগুন হইয়া উঠিত । এমনতরো সত্য অপবাদও সে সহ্য করিতে পারিত না । কিন্তু আজ তাহার প্রায়শ্চিত্ত আরম্ভ হইয়াছে ; সে রাগ করিল না । সে মনের মধ্যে তলাইয়া দেখিল হরিমোহিনী সত্য কথাই বলিতেছেন। সে সুচরিতার সঙ্গে বড়ো বাধনটা কাটিয়া ফেলিবার জন্য নির্মম হইয়া উঠিয়াছে ; কিন্তু একটি সূক্ষ্ম সূত্র, যেন দেখিতে পায় নাই এমনি ছিল করিয়া সে রাখিতে চায়। সে সুচরিতার সহিত সম্বন্ধকে একেবারে সম্পূর্ণরূপে ত্যাগ করিয়া দিতে এখনো পারে নাই । কিন্তু কৃপণতা ঘুচাইতে হই ে এক হাত দিয়া দান করিয়া আর-এক হাত দিয়া ধরিয়া রাখিলে চলিবে না । সে তখন কাগজ বাহির করিয়া বশ জোরের সঙ্গে বড়ো অক্ষরে লিখিল—