পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৩৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Vod R রবীন্দ্র-রচনাবলী এ হইলে তো নিন্দা টিকে না। প্রমাণ লইয়া দােষীকে দােষী সাব্যস্ত করা, সে তো হইল বিচার। সে গুরুভার কয়জন লইতে পারে, এবং এত সময়ই বা কাহার হাতে আছে ? তাহা ছাড়া পরের সম্বন্ধে এত অতিরিক্ত মাত্রায় কাহারও গরজ নাই। যদি থাকিত তবে পরের পক্ষে তাহা একেবারেই অসহ্য হইত। নিন্দুককে সহ্য করা যায়, কারণ, তাহার নিন্দুকতাকে নিন্দা করিবার সুখ আমারও হাতে আছে। কিন্তু বিচারককে সহ্য করবে কে ? বস্তুত আমরা অতি সামান্য প্রমাণেই নিন্দা করিয়া থাকি, নিন্দার সেই লাঘবতাটুকু না থাকিলে সমাজের হাড় গুড়া হইয়া যাইত। নিন্দার রায় চূড়ান্ত রায় নহে; নিন্দিত ব্যক্তি ইচ্ছা করিলে তাহার প্রতিবাদ না করিতেও পারে। এমন-কি, নিন্দাবােক্য হাসিয়া উড়াইয়া দেওয়াই সুবুদ্ধি বলিয়া গণ। কিন্তু নিন্দ যদি বিচারকের রায় হইত। তবে সুবুদ্ধিকে উকিল-মোক্তারের শরণা লইতে হইত। র্যােহাৱা ! জানেন তাহারা স্বীকার করবেন, উকিল-মোক্তারের সহিত করবার হাসির কথা নহে। অতএব দেখা যাইতেছে, সংসারের প্রয়োজন হিসাবে নিন্দার যতটুকু গুরুত্ব আবশ্যক তাহাও আছে, যতটুকু লঘুত্ব থাকা উচিত তাহারও অভাব নাই । পূর্বে যে পাঠকটি আমার কথায় অসহিষ্ণু হইয়া উঠিয়াছিলেন তিনি নিশ্চয়ই বলবেন, “তুচ্ছ অনুমানের উপরেই হউক বা নিশ্চিত প্রমাণের উপরেই হউক, নিন্দ যদি করিতেই হয় তবে বাথর সহিত করা উচিত— নিন্দায় সুখ পাওয়া উচিত নহে।” এমন কথা যিনি বলিবেন তিনি নিশ্চয়ই সহৃদয় ব্যক্তি । সুতরাং তঁহার বিবেচনা করিয়া দেখা উচিত— নিন্দায় নিন্দিত ব্যক্তি ব্যথা পায়, আবার নিন্দুকও যদি বেদনা বোধ করে, তবে সংসারে দুঃখবেদনার পরিমাণ কিরূপ অপরিমিতরূপে বাড়িয়া উঠে। তাহা হইলে নিমন্ত্রণসভা নিস্তব্ধ, বন্ধুসভা বিষাদে ম্রিয়মাণ, সমালোচকের চক্ষু অশ্রুধুত এবং তঁহার পাঠকগণের হৃদগহবর হইতে উষ্ণ দীর্ঘশ্বাস ঘন ঘন উচ্ছসিত । আশা করি, শনিগ্রহের অধিবাসীদেরও এমন দশা নয় । তা ছাড়া সুখও পাইব না। অথচ নিন্দাও করিব, এমন ভয়ংকর নিন্দুক মনুষ্যজাতিও নহে। মানুষকে বিধাতা এতই শৌখিন করিয়া সৃষ্টি করিয়াছেন যে, যখন সে নিজের পেট ভরাইয়া প্রাণরক্ষা করিতে যাইতেছে তখনো ক্ষুধানিবৃত্তি ও রুচিপরিতৃপ্তির যে সুখ সেটুকুও তাহার চাই— সেই মানুষ ট্রাম-ভাড়া করিয়া বন্ধুর বাড়ি গিয়া পরের নিন্দা করিয়া আসিবে অথচ তাহাতে সুখ পাইবে না, যে ধর্মনীতি এমন অসম্ভব প্রত্যাশা করে তাহা পূজনীয়, কিন্তু পালনীয় নহে। আবিষ্কার-মাত্রেরই মধ্যে সুখের অংশ আছে। শিকার কিছুমাত্র সুখের হইত না, যদি মুগা যেখানে-সেখানে থাকিত এবং ব্যাধকে দেখিয়া পলাইয়া না। যাইত। মৃগের উপরে আমাদের আক্রোশ আছে বলিয়াই যে তাহাকে মারি তাহা নহে, সে বেচারা গহন বনে থাকে এবং পলায়নপটু বলিয়া তাহাকে কাজেই মারিতে হয় । মানুষের চরিত্র, বিশেষত তাহার দোষগুলি, ঝোপঝাপের মধ্যেই থাকে এবং পায়ের শব্দ শুনিলেই দৌড় মারিতে চায়, এইজন্যই নিন্দার এত সুখ । আমি নাড়ীনক্ষত্র জানি, আমার কাছে কিছুই গোপন নাই, নিন্দুকের মুখে এ কথা শুনিলেই বােঝা যায়, সে ব্যক্তি জাত-শিকারি | তুমি তোমার যে অংশটা ৷ দেখাইতে চাও না। আমি সেইটাকেই তাড়াইয়া ধরিয়াছি। জলের মাছকে আমি ছিপ ফেলিয়া ধরি, আকাশের পাখিকে বাণ মারিয়া পাড়ি, বনের পশুকে জাল পাতিয়া বাধি— ইহা কত সুখের ! যাহা লুকায় তাহাকে বাহির করা, যাহা পালায় তাহাকে বাধা, ইহার জন্যে মানুষ কী না করে ! দুর্লভতর প্রতি মানুষের একটা মোহ আছে। সে মনে করে, যাহা সুলভ তাহা খাটি নহে, যাহা উপরে আছে তাহা আবরণমাত্র, যাহা লুকাইয়া আছে তাহাই আসল । এইজন্যই গোপনের পরিচয় পাইলে সে আর-কিছু বিচার না করিয়া প্রকৃতের পরিচয় পাইলাম বলিয়া হঠাৎ খুশি হইয়া উঠে। এ কথা সে মনে করে না যে, উপরের সত্যের চেয়ে নীচের সত্য যে বেশি সত্য তাহা নহে ; এ কথা তাহাকে বোঝানো শক্ত যে, সত্য যদি বাহিরে থাকে। তবুও তাঁহা সত্য এবং ভিতরে যেটা আছে সেটা যদি সত্য না হয় তবে তাহা অসত্য । এই মোহবশতই কাব্যের সরল সৌন্দর্য অপেক্ষা তাহার গভীর