পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৫৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

প্রাচীন সাহিত্য রামায়ণ শ্ৰীযুক্ত দীনেশচন্দ্র সেন মহাশয়ের ‘রামায়ণী কথা’র ভূমিক-স্বরূপে রচিত রামায়ণ-মহাভারতকে যখন জগতের অন্যান্য কাব্যের সহিত তুলনা করিয়া শ্রেণীবদ্ধ করা হয় নাই তখন তাহদের নাম ছিল ইতিহাস । এখন বিদেশীয় সাহিত্যভাণ্ডারে যাচাই করিয়া তাহদের নাম দেওয়া হইয়াছে ‘এপিক' । আমরা এপিক শব্দের বাংলা নামকরণ করিয়াছি মহাকাব্য | এখন আমরা রামায়ণ-মহাভারতকে মহাকাব্যই বলিয়া থাকি । মহাকাব্য নামটি ভালেই হইয়াছে। নামের মধ্যেই যেন তাহার সংজ্ঞাটি পাওয়া যায় । ইহাকে আমরা কোনো বিদেশী শব্দের অনুবাদ বলিয়া এখন যদি না স্বীকার করি তাহাতে ক্ষতি হয় না। অনুবাদ বলিয়া স্বীকার করিলে পরদেশীয় অলংকারশাস্ত্রের এপিক শব্দের লক্ষণের সহিত আগাগোড়া না মিলিলেই মহাকাব্য-নামধারীকে কৈফিয়ত দিতে হয়। এরূপ জবাবদিহির মধ্যে থাকা অনাবশ্যক বলিয়া মনে করি । মহাকাব্য বলিতে কী বুঝি আমরা তাহার আলোচনা করিতে প্রস্তুত আছি, কিন্তু এপিকের সঙ্গে তাহাকে আগাগোড়া মিলাইয়া দিব এমন পণ করিতে পারি না। কেমন করিয়াই বা করিব ? প্যারাডাইস লস্টকেও তো সাধারণে এপিক বলে, তা যদি হয় তবে রামায়ণ-মহাভারত এপিক নহেউভয়ের এক পঙক্তিতে স্থান হইতেই পারে না। মোটামুটি কাব্যকে দুই ভাগ করা যাক। কোনাে কাব্য বা একলা কবির কথা, কোনাে কাব্য বা বৃহৎ সম্প্রদায়ের কথা । একলা কবির কথা বলিতে এমন বুঝায় না যে, তাহা আর-কোনো লোকের অধিগম্য নহে, তেমন হইলে তাহাকে পাগলামি বলা যাইত। তাহার অর্থ এই যে, কবির মধ্যে সেই ক্ষমতাটি আছে, যাহাতে তাহার নিজের সুখদুঃখ, নিজের কল্পনা, নিজের জীবনের অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়া বিশ্বমানবের চিরন্তন হৃদয়বেগ ও জীবনের মর্মকথা। আপনি বাজিয়া উঠে | এই যেমন এক শ্রেণীর কবি হইল, তেমনি আর-এক শ্রেণীর কবি আছে যাহার রচনার ভিতর দিয়া একটি সমগ্ৰ দেশ, একটি সমগ্ৰ যুগ, আপনার হৃদয়কে, আপনার অভিজ্ঞতাকে ব্যক্ত করিয়া তাহাকে মানবের চিরন্তন সামগ্ৰী করিয়া তোলে | এই দ্বিতীয় শ্রেণীর কবিকে মহাকবি বলা যায় । সমগ্র দেশের, সমগ্ৰ জাতির সরস্বতী ইহাদিগকে আশ্রয় করিতে পারেন- ইহারা যাহা রচনা করেন তাহাকে কোনো ব্যক্তিবিশেষের রচনা বলিয়া মনে হয় না। মনে হয় যেন তাহা বৃহৎ বনস্পতির মতাে দেশের ভূতলজঠর হইতে উদ্ভূত হইয়া সেই নিপুণ হস্তের পরিচয় পাই। কিন্তু রামায়ণ-মহাভারতকে মনে হয় যেন জাহ্নবী ও হিমাচলের ন্যায় তাহারা ভারতেরই, ব্যাস-বাল্মীকি উপলক্ষমাত্র । বস্তুত ব্যাস-বাল্মীকি তো কাহারও নাম ছিল না । ও তো একটা উদ্দেশে নামকরণমাত্র। এতবড়ো বৃহৎ দুইটি গ্রন্থ, আমাদের সমস্ত ভারতবর্ষ-জোড়া দুইটি কাব্য, তাহাদের নিজের রচয়িতা কবিদের নাম হারাইয়া বসিয়া আছে- কবি আপন কাব্যের এতই অন্তরালে পড়িয়া গেছে।