পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৬৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

প্রাচীন সাহিত্য ৭২৩ মোহে যাহা অকৃতাৰ্থ মঙ্গলে তাহা পরিসমাপ্ত ; দেখাইয়াছেন, ধর্ম যে সেন্দির্যকে ধারণ করিয়া রাখে তাহাই ধ্রুব এবং প্রেমের শান্তসংযত কল্যাণরূপই শ্রেষ্ঠ রূপ ; বন্ধনেই যথার্থ শ্ৰী এবং উদ্ধৃঙ্খলতায় সৌন্দর্যের আশু বিকৃতি । ভারতবর্ষের পুরাতন কবি প্রেমকেই প্রেমের চরম গৌরব বলিয়া স্বীকার করেন নাই, মঙ্গলকেই প্রেমের পরম লক্ষ্য বলিয়া ঘোষণা করিয়াছেন । তাহার মতে নরনারীর প্রেম সুন্দর নহে, স্থায়ী নহে, যদি তাহা বন্ধ্য হয়, যদি তাহা আপনার মধ্যেই সংকীর্ণ হইয়া থাকে, কল্যাণকে । জন্মদান না করে এবং সংসারে পুত্রকন্যা-অতিথিপ্রতিবেশীর মধ্যে বিচিত্ৰসৌভাগ্যরূপে ব্যাপ্ত হইয়া না যায় | এক দিকে গৃহধর্মের কল্যাণবন্ধন, অন্য দিকে নির্লিপ্ত আত্মার বন্ধনমোচন, এই দুইই ভারতবর্ষের বিশেষ ভাব । সংসারমধ্যে ভারতবর্ষ বহু লোকের সহিত বহু সম্বন্ধে জড়িত, কাহাকেও সে পরিত্যাগ করিতে পারে না ; তপস্যার আসনে ভারতবর্ষ সম্পূর্ণ একাকী। দুইয়ের মধ্যে যে সমন্বয়ের অভাব নাই, দুইয়ের মধ্যে যাতায়াতের পথ– আদান-প্রদানের সম্পর্ক আছে, কালিদাস র্তাহার শকুন্তলায় কুমারসম্ভাবে তাহা দেখাইয়াছেন । তাহার তপোবনে যেমন সিংহশাবকে-নরশিশুতে খেলা করিতেছে তেমনি তাহার কাব্যতপোবনে যোগীর ভাব, গৃহীর ভাব বিজড়িত হইয়াছে। মদন আসিয়া সেই সম্বন্ধ বিচ্ছিন্ন করিবার চেষ্টা করিয়াছিল বলিয়া, কবি তাহার উপর বিজনিপাত করিয়া তপস্যার দ্বারা কল্যাণময় গৃহের সহিত অনাসক্ত তপোবনের সুপবিত্র সম্বন্ধ পুনর্বার স্থাপন করিয়াছেন। ঋষির আশ্রমভিত্তিতে তিনি গৃহের পত্তন করিয়াছেন এবং নরনারীর সম্বন্ধকে কামের হঠাৎ আক্রমণ হইতে উদ্ধার করিয়া তপঃপূত নির্মল যোগাসনের উপরে প্রতিষ্ঠিত করিয়াছেন। ভারতবষীয় সংহিতায় নরনারীর সংযত সম্বন্ধ কঠিন অনুশাসনের আকারে আদিষ্ট, কালিদাসের কাব্যে তাঁহাই সৌন্দর্যের উপকরণে গঠিত। সেই সৌন্দর্য, শ্ৰী হী এবং কল্যাণে উদভাসমান ; তাহা গভীরতার দিকে নিতান্ত একপরায়ণ এবং ব্যাপ্তির দিকে বিশ্বের আশ্রয়স্থল | তাহা ত্যাগের দ্বারা পরিপূর্ণ, দুঃখের দ্বারা চরিতার্থ এবং ধর্মের দ্বারা ধ্রুব । এই সৌন্দর্যে নরনারী দুর্নিবার দুরন্ত প্রেমের প্রলয়বেগে আপনাকে সংযত করিয়া মঙ্গলমহাসমুদ্রের মধ্যে পরমন্তব্ধতা লাভ করিয়াছে। এইজন্য তাহা বন্ধনবিহীন দুর্ধর্ষ প্রেমের অপেক্ষা মহান ও বিস্ময়কর । পৌষ ১৩০৮ শকুন্তলা শেকসপীিয়রের টেম্পেস্ট নাটকের সহিত কালিদাসের শকুন্তলার তুলনা মনে সহজেই উদয় হইতে পারে। ইহাদের বাহা সাদৃশ্য এবং আন্তরিক অনৈক্য আলোচনা করিয়া দেখিবার বিষয় । নির্জনলালিত মিরান্দার সহিত রাজকুমার ফার্দিনান্দের প্রণয় তাপসকুমারী শকুন্তলার সহিত দুষ্মন্তের প্রণয়ের অনুরূপ। ঘটনাস্থলটিরও সাদৃশ্য আছে ; এক পক্ষে সমুদ্রবেষ্টিত দ্বীপ, অপর পক্ষে তপোবন । এইরূপে উভয়ের আখ্যানমূলে ঐক্য দেখিতে পাই, কিন্তু কাব্যরসের স্বাদ সম্পূর্ণ বিভিন্ন, তাহা পড়িলেই অনুভব করিতে পারি। যুরোপের কবিকুলগুরু গেটে একটি মাত্র শ্লোকে শকুন্তলার সমালোচনা লিখিয়াছেন, তিনি কাব্যকে খণ্ড খণ্ড বিচ্ছিন্ন করেন নাই। তাহার শ্লোকটি একটি দীপাবর্তিকার শিখার ন্যায় ক্ষুদ্র, কিন্তু তাহা দীপশিখার মতোই সমগ্ৰ শকুন্তলাকে এক মুহুর্তে উদভাসিত করিয়া দেখাইবার উপায়। তিনি এক কথায় বলিয়াছেন, কেহ যদি তরুণ বৎসরের ফুল ও পরিণত বৎসরের ফল, কেহ যদি মর্ত ও স্বৰ্গ একত্র দেখিতে চায়, তবে শকুন্তলায় তাহা পাইবে । অনেকেই এই কথাটি কবির উচ্ছসমাত্ৰ মনে করিয়া লঘুভাবে পাঠ করিয়া থাকেন। র্তাহারা মোটামুটি মনে করেন, ইহার অর্থ এই যে, গেটের মতে শকুন্তলা কাব্যখনি অতি উপাদেয়। কিন্তু তাহা