পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৮৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Գ8 Հ রবীন্দ্র-রচনাবলী ধূলিশয্যায় বৃন্তচু্যত মুকুলটির মতো লুষ্ঠিত হইয়া পড়িয়া ছিল তাহা কি কেহ জানে ? সেদিনকার সেই বিশ্বব্যাপী বিলাপের মধ্যে এই বিদীর্যমান ক্ষুদ্র কোমল হৃদয়ের অসহ্য শোক কে দেখিয়ছিল ? যে ঋষিকবি ক্ৰৌঞ্চবিরহিণীর বৈধব্যদুঃখ মুহুর্তের জন্য সহ্য করিতে পারেন নাই, তিনিও একবার চাহিয়া দেখিলেন না । লক্ষ্মণ রামের জন্য সর্বপ্রকারে আত্মবিলোপ সাধন করিয়াছিলেন, সে গীেরব ভারতবর্ষের গৃহে, গৃহে আজও ঘোষিত হইতেছে, কিন্তু সীতার জন্য উৰ্মিলার আত্মবিলোপ কেবল সংসারে নহে, কাব্যেও ! লক্ষ্মণ র্তাহার দেবতাযুগলের জন্য কেবল নিজেকে উৎসর্গ করিয়াছিলেন, উৰ্মিলা নিজের চেয়ে অধিক নিজের স্বামীকে দান করিয়াছিলেন । সে কথা কাব্যে লেখা হইল না। সীতার অশ্রুজলে উৰ্মিলা একেবারে মুছিয়া গেল। লক্ষ্মণ তো বারো বৎসর ধরিয়া তাহার উপাস্য প্রিয়জনের প্রিয়কার্যে নিযুক্ত ছিলেননারী-জীবনের সেই বারোটি শ্রেষ্ঠ বৎসর উমিলার কেমন করিয়া কাটিয়াছিল ? সলজ নিবপ্রেমে আমোদিত বিকচােমুখ হৃদয়মুকুলটি লইয়া স্বামীর সহিত যখন প্রথমতম মধুরতম পরিচয়ের আরম্ভসময় সেই মুহুর্তে লক্ষ্মণ সীতাদেবীর রক্তচরণক্ষেপের প্রতি নতদৃষ্টি রাখিয়া বনে গমন করিলেন- যখন ফিরিলেন তখন নববধূর সুচিরপ্রণয়ালোকবঞ্চিত হৃদয়ে আর কি সেই নবীনতা ছিল ? পাছে সীতার সহিত উৰ্মিলার পরম দুঃখ কেহ তুলনা করে, তাই কি কবি সীতার স্বর্ণমন্দির হইতে এই শোকোজ্জ্বলা মহাদুঃখিনীকে একেবারে বাহির করিয়া দিয়াছেন- জানকীর পাদপীঠপার্থেও বসাইতে সাহস করেন নাই ? সংস্কৃত কাব্যের আর দুইটি তপস্বিনী আমাদের চিত্তক্ষেত্রে তপোবন রচনা করিয়া বাস করিতেছে। প্রিয়ংবদা আর অনসূয়া । তাহারা ভর্তুগৃহগামিনী শকুন্তলাকে বিদায় দিয়া পথের মধ্য হইতে কঁাদিতে কাদিতে ফিরিয়া আসিল, নাটকের মধ্যে আর প্রবেশ করিল না, একেবারে আমাদের হৃদয়ের মধ্যে আসিয়া আশ্রয় গ্রহণ করিল। জানি, কাব্যের মধ্যে সকলের সমান অধিকার থাকিতে পারে না । কঠিন হৃদয় কবি তাহার নায়ক-নায়িকার জন্য কত অক্ষয় প্রতিমা গড়িয়া গড়িয়া নির্মমচিত্তে বিসর্জন দেন । কিন্তু তিনি যেখানে যাহাকে কাব্যের প্রয়ােজন বুঝিয়া নিঃশেষ করিয়া ফেলেন। সেইখনেই কি তাহার সম্পূর্ণ শেষ হয় ? দীপ্তরোষ ঋষিশিষ্যদ্বয় এবং হতবুদ্ধি রোরুদ্যমান গৌতমী যখন তপোবনে ফিরিয়া আসিয়া উৎসুক উৎকণ্ঠিত সখী দুইটিকে রাজসভার বৃত্তান্ত জানাইল তখন তাহাদের কী হইল সে কথা শকুন্তলা নাটকের পক্ষে একেবারেই অনাবশ্যক, কিন্তু তাই বলিয়া কি সেই অকথিত অপরিমেয় বেদনা সেইখানেই ক্ষান্ত হইয়া গেল ? আমাদের হৃদয়ের মধ্যে কি বিনা ছন্দে, বিনা ভাষায় চিরদিন তাহা উদভ্ৰান্ত হইয়া ফিরিতে লাগিল না ? কাব্য হীরার টুকরার মতো কঠিন। যখন ভাবিয়া দেখি, প্রিয়ংবদা অনসূয়া শকুন্তলার কতখানি ছিল, তখন সেই কথাদুহিতার পরমতম দুঃখের সময়েই সেই সখী দিগকে একেবারেই অনাবশ্যক অপবাদ দিয়া সম্পূর্ণরূপে বর্জন করা কাব্যের পক্ষে ন্যায়বিচারসংগত হইতে পারে, কিন্তু তাহা নিরতিশয় নিষ্ঠুর। শকুন্তলার সুখসৌন্দর্য গৌরবগরিমা বৃদ্ধি করিবার জন্যই এই দুটি লাবণ্যপ্রতিমা নিজের সমস্ত দিয়া তাহাকে বেষ্টন করিয়াছিল। তিনটি সখী যখন জলের ঘট লইয়া অকালবিকশিত নবমালতীর তলে আসিয়া দাড়াইল তখন দুষ্মন্ত কি একা শকুন্তলাকে ভালোবাসিয়াছিলেন ? তখন হাস্যে কৌতুকে নবযৌবনের বিলোলমধুৰ্য্যে কাহারা শকুন্তলাকে সম্পূর্ণ করিয়া তুলিয়াছিল ? এই দুটি তাপসী সখী । একা শকুন্তলা শকুন্তলার একতৃতীয়াংশ । শকুন্তলার অধিকাংশই অনসূয়া এবং প্রিয়ংবদা, শকুন্তলাই সর্বাপেক্ষা অল্প। বারো-আনা প্রেমালাপ তো তাহারাই সুচারুরূপে সম্পন্ন করিয়া দিল । তৃতীয় অঙ্কে যেখানে একাকিনী শকুন্তলার সহিত দুষ্মন্তের প্ৰেমাকুলতা বর্ণিত আছে সেখানে কবি অনেকটা হীনবল হইয়াছিলেন- কোনোমতে অচিরে গৌতমীকে আনিয়া তিনি রক্ষা পাইলেন- কারণ, শকুন্তলাকে যাহারা আবৃত করিয়া সম্পূর্ণ করিয়াছিল তাহারা সেখানে ছিল না। বৃন্তচু্যত ফুলের উপর দিবসের