পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ত্রয়োদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩১৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

లింe রবীন্দ্র-রচনাবলী টেনিস-পাটিতে চা ঢালছে উচ্চ কলহাস্যে । অল্পবয়সে শুনেছি পুরোনো বাংলা গান- “মনে রইল সই মনের বেদনা- তারই সরল সুরের সঙ্গে মিশিয়ে চিরকালের বাঙালি মেয়ের একটা করুণ চেহারা আমি দেখতে পেতুম, অচিরাকে দেখে মনে হল সেইরকম বারোয়া গানে তৈরি বাণীমূর্তি, যে গান রেডিয়োতে বাজে না, গ্রামোফোনে পাড়া মুখর করে না । এদিকে আমার আপনার মধ্যে দেখলুম মনের নীচের তলাকার তপ্তবিগলিত একটা প্ৰদীপ্ত রহস্য হঠাৎ উপরের আলোতে উদগীর্ণ হয়ে উঠেছে। বুঝতে পারছি আমি যখন রোজ বিকেলে এই পথ দিয়ে কাজে ফিরেছি। অচিরা আমাকে দেখেছে, অন্যমনস্ক আমি ওকে দেখি নি। নিজের চেহারা সম্বন্ধে যে বিশ্বাস। এনেছি বিলেত থেকে, এই ঘটনা সম্পর্কে মনের মধ্যে তার প্রতিক্রিয়া যে হয় নি তা বলতে পারি। নে । কিন্তু সন্দেহও ছিল । বিলোতফেরত কোনো কোনো বন্ধুর কাছে শুনেছি, বিলিতি মেয়ের রুচির সঙ্গে বাঙালি মেয়ের রুচি মেলে না। এরা পুরুষের রূপে খোজে মেয়েলি মোলায়েম ছাদ । বাঙালি কার্তিক আর যাই হােক কোনো কালে দেবসেনাপতি ছিল না। এটা বলতে হবে আমাকেও ময়ুরে চড়ালে মানবে না। এতদিন এ-সব আলোচনা আমার মনের ধার দিয়েও যায় নি । কিন্তু কয়েকদিন ধরে আমাকে ভাবিয়েছে। রোদোপোড়া আমার রঙ, লম্বা। আমার দেহ, শক্ত আমার বাহু, দ্রুত আমার চলন, নাক চিবুক কপাল নিয়ে খুব স্পষ্ট রেখায় আঁকা আমার চেহারা । আমি নবনী নিন্দিত কবিতকাঞ্চনকান্তি বাঙালি মায়ের उ८ । न । আমার নিকটবর্তিনী বঙ্গনারীর সঙ্গে আমি মনে মনে ঝগড়া করেছি, একলা ঘরের কোণে বুক ফুলিয়ে বলেছি, “তোমার পছন্দ পাই আর নাই পাই এ কথা নিশ্চয় জেনো তোমার দেশের চেয়ে বড়ো বড়ো দেশের স্বয়ংবরসভার বরমাল্য উপেক্ষা করে এসেছি।” এই বানানো ঝগড়ার উন্মায় একদিন হেসে উঠেছি আপনি ছেলেমানুষিতে । আবার এদিকে বিজ্ঞানীর যুক্তিও কাজ করেছে ভিতরে ভিতরে। আপন মনে তর্ক করেছি, একান্ত নিভৃতে থাকাই যদি ওর প্রার্থনীয় তা হলে বার বার আমার সুস্পষ্ট দৃষ্টিপাত এড়িয়ে এতদিনে ও তো ঠাই বদল করত । কাজ সেরে এ পথ দিয়ে আগে যৌতুম একবার মাত্র, আজকাল যখন-তখন যাতায়াত করি, যেন এই জায়গাটাতেই সোনার খনির খবর পেয়েছি। কখনো স্পষ্ট যখন চোখোচে্যুখি হয়েছে আমার বিশ্বাস সেটাকে চার চোখের অপঘাত বলে ওর ধারণা হয় নি। এক-একদিন হঠাৎ পিছন ফিরে দেখেছি। আমার তিরোগমনের দিকে অচিরা তাকিয়ে আছে, ধরা পড়তেই দ্রুত চোখ ফিরিয়ে নিয়েছে। তথ্য সংগ্রহের কাজে লাগলুম। পাটনা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার কেমব্রিজের সতীর্থ প্রোফেসর আছেন বঙ্কিম । তাকে চিঠি লিখলুম, “তোমাদের বেহার সিভিল সার্ভিসে আছেন এক ভদ্রলোক, নাম ভবতোষ । আমার কোনো বন্ধু, তার মেয়ের জন্যে লোকটিকে উদবাহবন্ধনে জড়বার দুষ্কর্মে সাহায্য করতে আমাকে অনুরোধ করেছেন । জানতে চাই রান্তা খোলসা কি না, আর লোকটার মতিগতি কী *ՓN լ՚ উত্তর এল, “পাকা দেয়াল তোলা হয়ে গেছে, রান্তা বন্ধ । তার পরেও লোকটার মতিগতি সম্বন্ধে যদিকীেতুহল থাকে। তবে শোনো। এ দেশে থাকতে আমি ধার ছাত্র ছিলুম তার নাম নাই জানলে । তিনি পরম পণ্ডিত আর ঋষিতুল্য লোক । তার নাতনিটিকে যদি দেখ তা হলে জানবে সরস্বতী কেবল যে আবির্ভূত হয়েছেন অধ্যাপকের বিদ্যামন্দিরে তা নয় তিনি দেহ নিয়ে এসেছেন তার কোলে। এমন বুদ্ধিতে উজ্জ্বল অপরাপ সুন্দর চেহারা কখনো দেখি নি । “ভাবতোষ ঢুকল শয়তান তার স্বৰ্গলোকে । স্বল্পজল নদীর মতো বুদ্ধি তার অগভীর বলেই জ্বলজ্বল করে আর সেইজন্যেই তার বচনের ধারা অনর্গল। ভুললেন অধ্যাপক, ভুললেন নাতনি। রকমসকম দেখে আমাদের তো হাত নিসপিস করতে থাকত। কিছু বলবার পথ ছিল না- বিবাহের সম্বন্ধ পাকাপাকি, বিলেত গিয়ে সিভিলিয়ান হয়ে আসবে তারই ছিল অপেক্ষা । তারও পাথেয় এবং খরচ জুগিয়েছেন কন্যার পিতা। লোকটার সন্দির ধাত, একান্ত মনে কামনা করেছিলুম নুমোনিয়া হবে। হয় নি। পাস করলে পরীক্ষায় ; দেশে ফেরবামাত্র বিয়ে করলে ইন্ডিয়া গবর্মেন্টের উচ্চপদস্থ মুরবির