পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ত্রয়োদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৬৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

বিশ্বপরিচয় 6ሉ 8ዓ দেখা যায় প্রতি বছরের একটা করে চক্ৰচিহ্ন । এই চিহ্নগুলি কোনো কোনো জায়গায় ঘেঁষাৰ্ঘেষি কোনো কোনো জায়গায় ফাক ফাঁক । প্রত্যেক চক্ৰচিহ্ন থেকে বোঝা যায় গাছটা বৎসরে কতখানি করে বেড়েছে। আমেরিকায় এরিজোনার মরুপ্রায় প্রদেশে ডাক্তার ডগলাস দেখেছেন যে, যে বছরে সর্যের কালো দাগ বেশি দেখা দিয়েছে সেই বছরে গুড়ির দাগটা চওড়া হয়েছে বেশি। এরিজোনার পাইন গাছে পাঁচশো বছরের চিহ্ন গুনতে গুনতে ১৬৫০ থেকে ১৭১৫ খৃস্টােব্দ পর্যন্ত সূর্যের দাগের লক্ষণে একটা ফাক পড়ল। অবশেষে তিনি গ্রিনিজ মানযন্ত্র-বিভাগে সংবাদ নিয়ে জানলেন। ঐ-কটা বছরে সূর্যের দাগ প্রায় ছিল না। সর্যের দেহ থেকে যে প্রচুর আলো বেরিয়ে চলেছে তার অতি সামান্য ভাগ গ্রহগুলিতে ঠেকে । অনেকখানিই চলে যায় শূন্যে, সেকেণ্ডে এক লক্ষ ছিয়াশি হাজার মাইল বেগে ; কোনো নক্ষত্রে পৌঁছয় চার বছরে, কোনো নক্ষত্রে ত্ৰিশ হাজার বছরে, কোনো নক্ষত্রে নলক্ষ বছরে। আমরা মনে ভাবি সূর্য আমাদেরই, আর তার আলোর দানে আমাদেরই বেশি দাবি । কিন্তু এত আলোর একটুখানি মাত্র আমাদের ছুঁয়ে যায়। তার পরে সূর্যের এই আলোকের দূত সূর্যে আর ফেরে না, কোথায় যায়, বিশ্বের কোন কাজে লাগে কে জানে। জ্যোতিষ্কালোকদের সম্বন্ধে একটা আলোচনা বাকি রয়ে গেল । কোথা থেকে নিরস্তুর তাদের • তাপের জোগান চলছে তার সন্ধান করা দরকার পরমাণুদের মধ্যে । ইলেকট্রন-প্রোটনের যোগে যদি কখনো একটি হীলিয়মের পরমাণু সৃষ্টি করা যায় তা হলে সেই সৃষ্টিকার্যে যে প্রচণ্ড তেজের উদ্ভব হবে তার আঘাতে আমাদের পৃথিবীতে এক সর্বনাশী প্ৰলয়কাণ্ড ঘটবে । এ তো গড়ে তোেলবার কথা । কিন্তু বস্তু ধ্বংস করতে তার চেয়ে অনেকগুণ তীব্ৰ শক্তির প্রয়োজন । প্রোটনে ইলেকট্রনে যদি সংঘাত রাধে তা হলে সুতীব্র কিরণ বিকিরণ করে তখনই তারা মিলিয়ে যাবে । এতে যে প্রচণ্ড তেজের উদ্ভব হয় তা কল্পনাতীত । এইরকম কাপ্তটাই ঘটছে নক্ষত্রমণ্ডলীর মধ্যে । সেখানে বস্তু ধ্বংসের কাজ চলছে বলেই অনুমান করা সংগত । এই মত-অনুসারে সূর্য তিনশো ষাট লক্ষ কোটি টন ওজনের বস্তুপুঞ্জ প্রত্যহ খরচ করে ফেলছে। কিন্তু সূর্যের ভাণ্ডার এত বৃহৎ যে আরো বহু বহু কোটি বৎসর এইরকম অপব্যয়ের উদ্দামতা চলতে পারবে । কিন্তু বর্তমান বিশ্বের আয়ু সম্বন্ধে যে শেষ হিসেব অবধারিত হয়েছে সেটা মেনে নিলে বস্তু-ভাঙনের চেয়ে বস্তু-গড়নের মতটাই বেশি খাটে। যদি ধরে নেওয়া যায় যে এক সময়ে সূর্য ছিল গাইড্রোজেনের পুঞ্জ, তা হলে সেই হাইড্রোজেন থেকে ইলিয়ম গড়ে উঠতে যে তেজ জাগাবার কথা সেটা এখনকার হিসাবের সঙ্গে মেলে । অতএব এই বিশ্বজগৎটা ধ্বংসের দিকে, না গড়ে ওঠবার দিকে চলছে, না দুই একসঙ্গে ঘটছে সে সম্বন্ধে বিজ্ঞানীদের মতের মিল হয় নি। কয়েক বৎসর হল যে বিকীরণশক্তি ধরা পড়েছে যার নাম দেওয়া হয়েছে। কসমিক রশ্মি ; সেটার উদ্ভব না পৃথিবীতে না। সূর্যে, এমন-কি, না নক্ষত্ৰলোকে । নক্ষত্রপারপারের কোনো আকাশ হতে বিশ্বসৃষ্টির ভাঙন কিংবা গড়ন থেকে সে বেরিয়ে পড়েছে এইরকম আন্দাজ করা হয়েছে । যাই হােক, বিশ্বসৃষ্টি ব্যাপারের এই যে-সব বিপরীত বার্তাবহ-ইশারা আসছে বিজ্ঞানীদের পরীক্ষাগারে সেটা হয়তো কোনো-একটা জটিল গণনার ব্যাপারে এসে ঠেকবে । কিন্তু আমরা তো বিজ্ঞানী নই, বুঝতে পারি নে। হঠাৎ অঙ্কের আরম্ভ হয় কোথা থেকে, একেবারে শেষই বা হয় কোনখানে। সম্পূর্ণ সংঘটিত বিশ্বকে নিয়ে হঠাৎ কালের আরম্ভ হল। আর সদ্যোলুপ্ত বিশ্বের সঙ্গে কালের সম্পূর্ণ অন্ত হবে, আমাদের বুদ্ধিতে এর কিনারা পাই নে। বিজ্ঞানী বলবেন, বুদ্ধির কথা এখানে আসছে না, এ হল গণনার কথা ; সে গণনা বর্তমান ঘটনাধারার উপরে প্রতিষ্ঠিত- এর আদি-অন্তে যদি অন্ধকার দেখি তা হলে উপায় নেই।