পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ত্রয়োদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭০৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

r\" রবীন্দ্র-রচনাবলী মেজের উপর বসিয়া কোলে তাম্বুরা লইয়া তিনি গান ধরিলেন। আমি আশ্চর্য হইয়া গেলাম। এ তো হিলিমিলি পনিয়া' নহে ; রীতিমত আলাপ করিয়া তিনি কানাড়া মালকোষ বেহাগ গান করিলেন। তাহাতে সমস্ত দুরূহ মিড় এবং তান লাগাইলেন, হাতের ইঙ্গিতে তাল দিতে লাগিলেন ; বিলাতি সম্মার্জনী বুলাইয়া আমাদের সংগীত হইতে তাহার ভারতববীয়ত্ব বারো-আনা পরিমাণ ঘষিয়া তুলিয়া ফেলিলেন না। আমাদের ওস্তাদের সঙ্গে প্ৰভেদ এই যে ইহার কণ্ঠস্বরে কোথাও যেন কোনো বাধা নাই ; শরীরের মুদ্রায় বা গলার সুরে কোনো কষ্টকর প্রয়াসের লক্ষণ দেখা গেল না। গানের মূর্তি একেবারে অক্ষুধা আক্রান্ত হইয়া দেখা দিতে লাগিল । এ দেশে এই যাহারা ভারতবষীয় সংগীতের আলোচনায় প্রবৃত্ত আছেন, ইহারা যে কেবলমাত্র কৌতুহল চরিতার্থ করিতেছেন তাহা নহে ; ইহারা ইহার মধ্যে একটা অপূর্ব সৌন্দর্য দেখিতে পাইয়াছেন- সেই রাসটিকে গ্ৰহণ করিবার জন্য, এমনকি, সম্ভবমত আপনাদের সংগীতের অঙ্গীভূত করিয়া লইবার জন্য ইহারা উৎসুক হইয়াছেন। ইহাদের সংখ্যা এখনো নিতান্তই অল্প সন্দেহ নাই, কিন্তু আগুন একটা কোণেও যদি লাগে। তবে আপনার তেজেই চারি দিকে ছড়াইয়া পড়ে। এখানকার লণ্ডন অ্যাকাডেমি অফ মুজিকের অধ্যক্ষ ডাক্তার ইয়ৰ্কটুটারের সঙ্গে আমার দেখা হইয়াছে। তিনি ভারতবষীয় সংগীতের কিছু কিছু পরিচয় পাইয়াছেন। যাহাতে লণ্ডনে এই সংগীত আলোচনার একটা উপায় ঘটে। সেজন্য আমার নিকট তিনি বারংবার ঔৎসুক্য প্রকাশ করিয়াছেন। যদি কোনাে ভারতবষীয় ধনী রাজা কােনাে বড়ো ওস্তাদ বীণাবাদককে এখানে কিছুকাল রাখিতে পারেন তাহা হইলে, তাহার মতে, বিস্তর উপকার হইতে পারে। উপকার আমাদেরই সবচেয়ে বেশি । কেননা, আমাদের শিল্পসংগীতের প্রতি শ্ৰদ্ধা আমরা হারাইয়াছি । আমাদের জীবনের সঙ্গে তাহার যোগ নিতান্তই ক্ষীণ হইয়া আসিয়াছে। নদীতে যখন ভাটা পড়ে তখন কেবল পাক বাহির হইয়া পড়িতে থাকে ; আমাদের সংগীতের স্রোতস্বিনীতে জোয়ার উত্তীর্ণ হইয়া গিয়াছে বলিয়া আমরা আজকাল তাহার তলদেশের পঙ্কিলতার মধ্যে লুটাইতেছি। তাহাতে স্নানের উলটা কাজ হয়। আমাদের ঘরে ঘরে গ্রামোফোনে যে-সকল সুর বাজিতেছে, থিয়েটার হইতে যে-সকল গান শিখিতেছি, তাহা শুনিলেই বুঝিতে পারিব, আমাদের চিত্তের দারিদ্র্যে কদৰ্যতা যে কেবল প্ৰকাশমান হইয়া পড়িয়াছে তাহা নহে, সেই কদৰ্যতাকেই আমরা অঙ্গের ভূষণ বলিয়া ধারণ করিতেছি। সন্তা খেলো জিনিসকে কেহ একেবারে পৃথিবী হইতে বিদায় করিতে পারে না। ; একদল লোক সকল সমাজেই আছে, তাহদের সংগতি তাহার উর্ধে উঠিতে পারে না- কিন্তু, যখন সেই সকল লোকেই দেশ ছাইয়া ফেলে তখনই সরস্বতী সস্তা দামের কালের পুতুল হইয়া পড়েন। তখনই আমাদের সাধনা হীনবল হয় এবং সিদ্ধিও তদনুরূপ হইয়া থাকে। সুতরাং এখন গ্রামোফোন ও কন্সটপটির আগাছায় দেশ দেখিতে দেখিতে ছাইয়া যাইবে ; যে সোনার ফসলের চাষ দরকার সে ফসল মারা যাইতেছে। সংগীতের পরিচয় লইতে তোমাদিগকে য়ুরোপে যাইতে হইবে।” আমাদের দেশের অনেক জিনিসকেই যুরোপের হাত হইতে পাইবার জন্য আমরা হাত পাতিয়া বসিয়াছি। আমাদের সংগীতকেও একবার সমুদ্রপার করিয়া তাহার পরে যখন তাহকে ফিরিয়া পাইব তখনই হয়তো ভালো করিয়া পাইব । আমরা বহুকাল ঘরের কোণে কাটাইয়াছি, এইজন্য কোনো জিনিসের বাজারদার জানি না ; নিজের জিনিসকে যাচাই করিয়া লইব, কোনখানে আমাদের গীেরব তাহা নিশ্চিত করিয়া বুঝিব, সে শক্তি उामाoआद्र नदै । যেখানে মানুষের সকল চেষ্টাই প্রচুর প্রাণশক্তি হইতে নিয়ত নানা আকারে উৎসারিত হইতেছে, যেখানে মানুষের সমন্ত সম্পদ জীবনের বৃহৎ কারবারে খাটিতেছে এবং মুনফায় বাড়িয়া চলিয়াছে, সেইখানে আপনাদের সামগ্ৰীকে না আনিলে, সেই চলতি কারবারের সঙ্গে যোগ দিতে না পারিলে, আমরা আপনার পরিচয় পাইতে পারিব না ; সুতরাং আমাদের অনেক শক্তি কেবল নষ্ট হইতে