পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ত্রয়োদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭১৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Seabr রবীন্দ্র-রচনাবলী মানুষ এখানে নোটের নুড়ি কুড়াইয়া ডিগ্রির বস্তা বোঝাই করিয়া তুলিতেছে, কিন্তু তাহা জীবনের খাদ্য নহে । তাহার গীেরব কেবল বোঝাইয়ের গৌরব, তাহ প্ৰাণের গীেরব নহে। সামাজিক বিদ্যালয়ের পুরাতন শিকল এবং রাজকীয় বিদ্যালয়ের নূতন শিকল দুইই আমাদের মনকে যে পরিমাণে বধিতেছে সে পরিমাণে মুক্তি দিতেছে না। ইহাই আমাদের একমাত্র সমস্যা। নতুবা নূতন প্ৰণালীতে কেমন করিয়া ইতিহাস মুখস্থ সহজ হইয়াছে বা অঙ্ক কন্যা মনোরম হইয়াছে, সেটাকে আমি বিশেষ খাতির করিতে চাই না। কেননা আমি জানি, আমরা যখন প্ৰণালীকে খুঁজি তখন একটা অসাধ্য সন্তা পথ খুঁজি। মনে করি, উপযুক্ত মানুষকে যখন নিয়মিত ভাবে পাওয়া শক্ত তখন বাধা প্ৰণালীর দ্বারা সেই অভাব পূরণ করা যায় কি না। মানুষ বার বার সেই চেষ্টা করিয়া বার বারই অকৃতকার্য হইয়াছে এবং বিপদে পড়িয়ছে। ঘুরিয়া ফিরিয়া যেমন করিয়াই চলি-না কেন, শেষকালে এই অলঙ্ঘ্য সত্যে আসিয়া ঠেকিতেই হয় যে, শিক্ষকের দ্বারাই শিক্ষাবিধান হয়, প্ৰণালীর দ্বারা হয় না। মানুষের মন চলনশীল, এবং চলনশীল মনই তাহাকে বুঝিতে পারে। এ দেশেও পুরাকাল হইতে আজ পর্যন্ত এক-একজন বিখ্যাত শিক্ষক জন্মিয়াছেন ; তঁহারই ভগীরথের মতো শিক্ষার পুণ্যস্রোতকে আকর্ষণ করিয়া সংসারের পাপের বোঝা হ্রাস করিয়াছেন ও মৃত্যুর জড়তা দূর করিয়াছেন। তাহারাই শিক্ষাসম্বীয় সমস্ত বাধা বিধানের বাধার ভিতর দিয়াও ছাত্রদের মনে প্ৰাণপ্ৰবাহ সঞ্চারিত করিয়া দিয়াছেন । আমাদের দেশেও ইংরেজি শিক্ষার আরম্ভদিনের কথা স্মরণ করিয়া দেখো । ডিরোজিয়ো, কপ্তেন রিচার্ডসন, ডেভিড হেয়ার, ইহারা শিক্ষক ছিলেন; শিক্ষার ছােচ ছিলেন না, নোটের বোঝার বাহন ছিলেন না। তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের বৃহ এমন ভয়ংকর পাকা ছিল না ; তখন তাহার মধ্যে আলো এবং হাওয়া প্রবেশের উপায় ছিল ; তখন নিয়মের ফঁাকে শিক্ষক আপনি আসন পাতিবার স্থান করিয়া লাইতে পারিতেন । যেমন করিয়া হউক, আমাদের দেশে বিদ্যার ক্ষেত্ৰকে প্রাচীরমুক্ত করিতেই হইবে। রাজনৈতিক আন্দোলন প্রভৃতি বাহ্য পন্থায় আমরা আমাদের চেষ্টাকেবিক্ষিপ্ত করিয়া ফেলিয়াবিশেষ কোনো ফল পাইতেছি না । সেই শক্তিকে ও উদ্যমকে সফলতার পথে প্রবাহিত করিয়া স্বাধীনভাবে দেশকে শিক্ষাদানের ভার আমাদের নিজেকে লাইতে হইবে । দেশের কাজে যাহারা আত্মসমৰ্পণ করিতে চান এইটেই তাহদের সবচেয়ে প্রধান কাজ । নানা শিক্ষকের নানা পরীক্ষার ভিতর দিয়া আমাদের দেশের শিক্ষার স্রোতাকে সচল করিয়া তুলিতে পারিলে তবেই তাহা আমাদের দেশের স্বাভাবিক সামগ্ৰী হইয়া উঠিবে। তবেই আমরা স্থানে স্থানে ও ক্ষণে ক্ষণে যথার্থ শিক্ষকের দেখা পাইব । তবেই স্বভাবের নিয়মে শিক্ষকপরম্পরা। আপনি জাগিয়া উঠিতে থাকিবে । “জাতীয়’ নামের দ্বারা চিহ্নিত করিয়া আমরা কোনো-একটা বিশেষ শিক্ষাবিধিকে উদ্ভাবিত করিয়া তুলিতে পারি না। যে শিক্ষা স্বজাতির নানা লোকের নানা চেষ্টার দ্বারা নানা ভাবে চালিত হইতেছে তাহাকেই জাতীয় বলিতে পারি । স্বজাতীয়ের শাসনেই হউক আর বিজাতীয়ের শাসনে হউক, যখন কোনো-একটা বিশেষ শিক্ষাবিধি সমস্ত দেশকে একটা-কোনো ধ্রুব আদর্শে বঁধিয়া ফেলিতে চায় তখন তাহাকে জাতীয় বলিতে পারিব না- তাহা সাম্প্রদায়িক, অতএব জাতির পক্ষে তাহা সাংঘাতিক । , শিক্ষা সম্বন্ধে একটা মহৎ সত্য আমরা লিখিয়ছিলাম। আমরা জানিয়াছিলাম, মানুষ মানুষের কাছ হইতেই শিখিতে পারে, যেমন জলের দ্বারাই জলাশয় পূর্ণ হয়, শিখার দ্বারাই শিখা জ্বলিয়া উঠে, প্রাণের দ্বারাই প্ৰাণ সঞ্চারিত হইয়া থাকে। মানুষকে ছটিয়া ফেলিলেই সে তখন আর মানুষ থাকে না- সে তখন আপিস-আদালতের বা কল-কারখানার প্রয়োজনীয় সামগ্ৰী হইয়া উঠে ; তখনি সে মানুষ না হইয়া মাস্টারমশায় হইতে চায় ; তখনি সে আর প্রাণ দিতে পারে না, কেবল পাঠ দিয়া যায় । গুরুশিষ্যের পরিপূর্ণ আখীয়তার সম্বন্ধের ভিতর দিয়াই শিক্ষাকার্যাসজীবদেহের শোণিতস্রোতের মতো চলাচল করিতে পারে। কারণ, শিশুদের পালন ও শিক্ষণের যথার্থ ভার পিতামাতার উপর। কিন্তু, পিতামাতার সে যোগ্যতা অথবা সুবিধা না থাকাতেই, অন্য উপযুক্ত লোকের সহায়তা অত্যাবশ্যক হইয়া ওঠে । এমন অবস্থায় গুরুকে পিতামাতা না হইলে চলে না। আমরা জীবনের শ্ৰেষ্ঠ জিনিসকে