পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩১৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গল্পগুচ্ছ ○○> তিনি যে প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিবেন তাহার কোনোটিরই উত্তর দিতে পরিবে না ! একটি- একটিএকটিরও না ! তখন ! তখন শশিভূষণ অত্যন্ত জব্দ হইবে । গিরিবালার দুই চক্ষু জলে ভরিয়া আসিল । পড়া ভুলিয়া গেলে শশিভূষণের যে কিরূপ তীব্র অনুতাপের কারণ হইবে তাহা মনে করিয়া সে পীড়িত হৃদয়ে কিঞ্চিৎ সান্তনা লাভ করিল, এবং কেবলমাত্র শশিভূষণের দোষে বিস্মৃতশিক্ষা সেই হতভাগিনী ভবিষ্যৎ গিরিবালাকে কল্পনা করিয়া তাহার নিজের প্রতি করুণারস উচ্ছলিত হইয়া উঠিল । আকাশে মেঘ করিতে লাগিল ; বর্ষাকালে এমন মেঘ প্রতিদিন করিয়া থাকে । গিরিবালা পথের প্রান্তে একটা গাছের আড়ালে দাড়াইয়া অভিমানে ফুলিয়া ফুলিয়া কাদিতে লাগিল ; এমন অকারণ কান্না প্ৰতিদিন কত বালিকা কাদিয়া থাকে ! উহার মধ্যে লক্ষ্য করিবার বিষয় কিছুই ছিল না । ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ শশিভূষণের আইন সম্বন্ধীয় গবেষণা এবং বক্ততাচৰ্চা কী কারণে ব্যর্থ হইয়া গেল তাহা পাঠকদের অগোচর নাই । ম্যাজিষ্ট্রেটের নামে মকদ্দমা অকস্মাৎ মিটিয়া গেল। হরকুঞ্জার তাহাদের জেলার বেঞ্চে অনরারি ম্যাজিষ্ট্রেট নিযুক্ত হইলেন । একখানা মলিন চাপকন ও তৈলাক্ত পাগড়ি পরিয়া হরকুমার শশিভূষণের সেই কালো মোটা বইখানার প্রতি এতদিন পরে গিরিবালার অভিশাপ ফলিতে আরম্ভ করিল, সে একটি অন্ধকার কোণে নির্বাসিত হইয়া অনাদৃত বিস্মৃতভাবে ধূলিস্তরসংগ্রহে প্ৰবৃত্ত হইল। কিন্তু তাহার অনাদর দেখিয়া যে বালিকা আনন্দ লাভ করিবে সেই গিরিবালা কোথায় । শশিভূষণ যেদিন প্রথম আইনের গ্রন্থ বন্ধ করিয়া বসিলেন সেই দিনই হঠাৎ বুঝিতে পারিলেন, গিবিবালা আসে নাই । তখন একে একে এই কয়দিনের ইতিহাস অল্পে অল্পে তাহার মনে পড়িতে লাগিল । মনে পড়িতে লাগিল, একদিন উজ্জ্বল প্ৰভাতে গিরিবালা অঞ্চল ভরিয়া নববর্ষার আদ্ৰ বকুলফুল আনিয়াছিল । তাহাকে দেখিয়াও যখন তিনি গ্ৰন্থ হইতে দৃষ্টি তুলিলেন না, তখন তাহার উচ্ছাসে সহসা বাধা পড়িল । সে তাহার অঞ্চলবিদ্ধ একটা সূচস্তা বাহির করিয়া নতশিরে একটি একটি করিয়া ফুল লইয়া মালা গাঁথিতে লাগিল- মালা অত্যন্ত ধীরে ধীরে গাথিল, অনেক বিলম্বে শেষ হইল, বেলা হইয়া আসিল, গিরিবালার ঘরে ফিরিবার সময় হইল, তথাপি শশিভূষণের পড়া শেষ হইল না । গিরিবালা মালাটা তক্তপোশের উপর রাখিয়া স্নানভাবে চলিয়া গেল । মনে পড়িল, তাহার অভিমান প্রতিদিন কেমন করিয়া ঘনীভূত হইয়া উঠিল ; কবে হইতে সে তাহার ঘরে প্রবেশ না করিয়া ঘরের সম্মুখবতী পথে মধ্যে মধ্যে দেখা দিত এবং চলিয়া যাইত ও অবশেষে কবে হইতে বালিকা সেই পথে আসাও বন্ধ করিয়াছে, সেও তো আজ কিছুদিন হইল। গিরিবালার অভিমান তো এতদিন স্থায়ী হয় না । শশিভূষণ একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া হতবুদ্ধি হত্যকর্মের মতো দেয়ালে পিঠ দিয়া বসিয়া রহিলেন । ক্ষুদ্র ছাত্রীটি না আসাতে তাহার পাঠ্যগ্রন্থগুলি নিতান্ত বিস্বাদ হইয়া আসিল । বই টানিয়া টানিয়া লইয়া দুই-চারিপাত পডিয়া ফেলিয়া দিতে হয় । লিখিতে লিখিতে ক্ষণে ক্ষণে সচকিতে পথের দিকে দ্বারের অভিমুখে প্ৰতীক্ষাপূর্ণ দৃষ্টি বিক্ষিপ্ত হইতে থাকে এবং লেখা ভঙ্গ হয় । শশিভূষণের আশঙ্কা হইল, গিরিবালার অসুখ হইয়া থাকিবে । গোপনে সন্ধান লইয়া জানিলেন, সে মুদ্র সমূলক। পিরবালা আজকাল আর ঘর হইতে বাহির হয় না। তাহার জন্য পাত্ৰ স্থির গিরি যেদিন চারুপাঠের ছিন্নখণ্ডে গ্রামের পঙ্কিল পথ বিকীর্ণ করিয়াছিল তাহার পরদিন প্ৰত্যুষে ক্ষুদ্র অঞ্চলে বিচিত্র উপহার সংগ্ৰহ করিয়া দ্রুতপদে ঘর হইতে বাহির হইয়া আসিতেছিল । অতিশয় গ্ৰীষ্ম হওয়াতে নিদ্রাহীন রাত্রি অতিবাহন করিয়া হরকুমার ভোরবেলা হইতে বাহিরে বসিয়া গা খুলিয়া তামাক