পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩২৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

\SC S Ve r রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী স্বেচ্ছাপূর্বক মিথ্যা কথা শুনিতে চাহে তখন একটা মুখের কথায় তাহাকে বাধিত করিতে দোষ দেখি না । যে রসনা গোরু খাইয়াছে সে রসনাকে গোময় এবং মিথ্যা কথা নামক দুটাে কদৰ্য পদার্থ দ্বারা বিশুদ্ধ করিয়া লওয়া আমাদের আধুনিক সমাজের নিয়ম ; আমি সে নিয়ম লঙঘন করিতে চাহি না ।” প্ৰায়শ্চিত্ত করিয়া সমাজে উঠিবার একটা শুভদিন নির্দিষ্ট হইল । ইতিমধ্যে অনাথবন্ধু কেবল যে তিচাদর পরিলেন তাহা নহে, তর্ক এবং উপদেশের দ্বারা বিলাতি সমাজের গালে কালি এবং হিন্দুসমাজের গালে চুন লেপন করিতে লাগিলেন । যে শুনিল সকলেই খুশি হইয়া टेलेिब्त । আনন্দে গর্বে বিন্ধ্যবাসিনীর প্রীতিসুধাসিক্ত কোমল হৃদয়টি সর্বত্র উচ্ছসিত হইতে লাগিল । সে মনে বাঙালি বলিয়া চিনিবার জো থাকে না, কিন্তু আমার স্বামী একেবারে অবিকৃতভাবে ফিরিয়াছেন। বরঞ্চ যথানির্দিষ্ট দিনে ব্ৰাহ্মণপণ্ডিতে রাজকুমারবাবুর ঘর ভরিয়া গেল । অর্থব্যয়ের কিছুমাত্র ত্রুটি হয় নাই । আহার এবং বিদায়ের আয়োজন যথোচিত হইয়াছিল । অন্তঃপুরেও সমারোহের সীমা ছিল না । নিমন্ত্রিত পরিজনবর্গের পরিবেশন ও পরিচর্যায় সমস্ত প্ৰকোষ্ঠ ও প্রাঙ্গণ সংক্ষুব্ধ হইয়া উঠিয়াছিল । সেই ঘোরতর কোলাহল এবং কর্মরাশির মধ্যে বিন্ধ্যবাসিনী প্ৰফুল্লমুখে শারদরৌদ্ররঞ্জিত প্রভাতবায়ুবাহিত লঘু মেঘখণ্ডের মতো আনন্দে ভাসিয়া বেড়াইতেছিল । আজিকার দিনের সমস্ত বিশ্বব্যাপারের প্রধান নায়ক তাহার স্বামী । আজ যেন সমস্ত বঙ্গভূমি একটিমাত্র রঙ্গভূমি হইয়াছে এবং যবনিক উদঘাটনপূর্বক একমাত্ৰ অনাথবন্ধুকে বিস্মিত বিশ্বদর্শকের নিকট প্রদর্শন করাইতেছে । প্ৰায়শ্চিত্ত যে অপরাধস্বীকার তাহা নহে, এ যেন অনুগ্রহ তুলিয়াছেন । এবং সেই গৌরবচ্ছটা সমস্ত দেশ হইতে সহস্র রশ্মিতে বিচ্ছরিত হইয়া বিন্ধাবাসিনীর প্রেমপ্রমূদিত মুখের উপরে অপব্দীপ মহিমাজ্যোতি বিকীর্ণ করিতেছে । এতদিনকার তুচ্ছ জীবনের সমস্ত দুঃখ এবং ক্ষুদ্র অপমান দূর হইয়া সে আজ তাহার পরিপূর্ণ পিতৃগৃহে সমস্ত আত্মীয়স্বজনের সমক্ষে উন্নতমস্তকে গৌরবের আসনে আরোহণ করিল । স্বামীর মহত্ত্ব আজ অযোগ্য স্ত্রীকে বিশ্বসংসারের নিকট সম্মানাস্পদ করিয়া তুলিল । অনুষ্ঠান সমাধা হইয়াছে । অনাথবন্ধু জাতে উঠিয়াছেন । অভ্যাগত আত্মীয় ও ব্রাহ্মণগণ র্তাহার সহিত একাসনে বসিয়া তৃপ্তিপূর্বক আহার শেষ করিয়াছেন । আত্মীয়েরা জামাতাকে দেখিবার জন্য অন্তঃপুরে ডাকিয়া পাঠাইলেন । জামাতা সুস্থচিত্তে তাম্বল চর্বণ করিতে করিতে প্ৰসন্নহাস্যমুখে আলস্যমন্থরগমনে ভূমিলুণ্ঠ্যমান চাদরে অন্তঃপুরে যাত্রা করিলেন । আহারান্তে ব্ৰাহ্মণগণের দক্ষিণার আয়োজন হইতেছে এবং ইত্যাবসরে তাহারা সভাস্থলে বসিয়া তুমুল কলহসহকারে পাণ্ডিত্য বিস্তার করিতেছেন । কর্তা রাজকুমারবাবু ক্ষণকাল বিশ্রাম উপলক্ষে সেই কোলাহলাকুল পণ্ডিতসভায় বসিয়া স্মৃতির তর্ক শুনিতেছেন, এমন সময় দ্বারবান গৃহস্বামীর হস্তে এক কার্ড দিয়া খবর দিল, “এক সাহেবলেগৰকা মেম আয় ।” রাজকুমারবাবু চমৎকৃত হইয়া উঠিলেন । পরীক্ষণেই কার্ডের প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়া দেখিলেন, তাহাতে ইংরাজিতে লেখা রহিয়াছে— মিসেস অনাথবন্ধু সরকার । অর্থাৎ, অনাথবন্ধু সরকারের স্ত্রী { রাজকুমারবাবু অনেকক্ষণ নিরীক্ষণ করিয়া কিছুতেই এই সামান্য একটি শব্দের অর্থগ্রহ করিতে পারিলেন না } এমন সময়ে বিলাত হইতে সদ্যঃপ্রত্যাগতা আরক্তকপোলা আতাম্রকুন্তলা আনীললোচনা দুগ্ধফেনশুভ্ৰ হরিণলঘুগামিনী ইংরাজমহিলা স্বয়ং সভাস্থলে আসিয়া দাড়াইয়া প্ৰত্যেকের মুখ নিরীক্ষণ করিতে লাগিলেন । কিন্তু পরিচিত প্রিয়মুখ দেখিতে পাইলেন না । অকস্মাৎ মেমকে দেখিয়া সংহিতার সমস্ত তর্ক থামিয়া সভাস্থল শ্মশানের ন্যায় গভীর নিস্তব্ধ হইয়া গেল ।