পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৪৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8义b... রবীন্দ্র-রচনাবলী বেশি । দরোয়ান ইহাক দিচ্ছে, বেহারাদের ছেলেরা চোচামেচি করছে, মেথরদের মহলে ঘোরতর ঝগড়া বেধে গেছে, মারোয়াড়ি প্রতিবেশিনীরা চীৎকার শব্দে একঘেয়ে গান ধরেছে, তার আর অন্তই নেই। আর, ঘরের ভিতরে নানা জিনিসপত্রের ব্যবস্থা এবং অব্যবস্থা- তার বোঝা কি কম । সেই বোঝা কি কেবল ঘরের মেঝে বহন করছে । তা নয়, প্ৰতি ক্ষণেই আমাদের মন বহন করছে । যা গোছালো তার, বোঝা কম, যা অগোছালো তার বোঝা আরো বেশি, এই যা তফাত । যেখানে একটা দেশের সমস্ত দেশ জুড়ে তাদের যে কতখানি শক্তি জমে উঠছে তার কি হিসেব আছে। জাপানিরা যে রাগ করে না তা নয়, কিন্তু সকলের কাছেই একবাক্যে শুনেছি, এরা ঝগড়া করে না । এদের গালাগালির অভিধানে একটিমাত্ৰ কথা আছে- বোকা- তার উদ্ধের্ব এদের ভাষা পৌছয় না ! ঘোরতর রাগারগি মনান্তর হয়ে গেল, পাশের ঘরে তার টু শব্দ পৌছল না, এইটি হচ্ছে জাপানি রীতি । শোকদুঃখ সম্বন্ধেও এইরকম স্তব্ধতা । এদের জীবনযাত্রায় এই রিক্ততা, বিরলতা, মিতাচার কেবলমাত্র যদি অভাবাত্মক হত তা হলে সেটাকে প্ৰশংসা করবার কোনো হেতু থাকত না । কিন্তু, এই তো দেখছি— এরা ঝগড়া করে না বটে। অথচ প্ৰয়োজনের সময় প্ৰাণ দিতে, প্ৰাণ নিতে এরা পিছপাও হয় না । জিনিসপত্রের ব্যবহারে এদের সংযম, কিন্তু জিনিসপত্রের প্রতি প্ৰভুত্ব এদের তো কম নয় । সকল বিষয়েই এদের যেমন শক্তি তেমনি নৈপুণ্য, তেমনি সৌন্দর্যবোধ । এ সম্বন্ধে যখন আমি এদের প্রশংসা করেছি, তখন এদের অনেকের কাছেই শুনেছি যে, “এটা আমরা বৌদ্ধধর্মের প্রসাদে পেয়েছি । অর্থাৎ, বৌদ্ধধর্মের এক দিকে সংযম আর-এক দিকে মৈত্রী, এই যে সামঞ্জস্যের সাধনা আছে। এতেই আমরা মিতাচারের দ্বারাই অমিত শক্তির অধিকার পাই । বৌদ্ধধর্ম যে মধ্যপথের ধর্ম।” শুনে আমার লজা বোধ হয় । বৌদ্ধধর্ম তো আমাদের দেশেও ছিল, কিন্তু আমাদের জীবনযাত্রাকে তো এমন আশ্চর্য ও সুন্দর সামঞ্জস্যে বেঁধে তুলতে পারে নি । আমাদের কল্পনায় ও কাজে এমনতরো প্ৰভূত আতিশয্য, ঔদাসীন্য, উচ্ছঙ্খলতা কোথা থেকে এল । একদিন জাপানি নাচ দেখে এলুম। মনে হল, এ যেন দেহভঙ্গির সংগীত । এই সংগীত আমাদের দেশের বীণার আলাপ | অর্থাৎ পদে পদে মীড । ভঙ্গিবৈচিত্র্যের পরস্পরের মাঝখানে কোনো ফাক নেই কিংবা কোথাও জোড়ের চিহ্ন দেখা যায় না ; সমস্ত দেহ পুষ্পিত লতার মতো একসঙ্গে দুলতে দুলতে সৌন্দর্যের পুষ্পবৃষ্টি করছে। খাটি যুরোপীয় নাচ অর্ধনারীশ্বরের মতো, আধখানা ব্যায়াম, আধখানা নােচ ; তার মধ্যে লম্বফঝাম্প, ঘুরপাক, আকাশকে লক্ষ্য করে লাথি-ছোড়াছড়ি আছে। জাপানি নাচ একেবারে পরিপূর্ণ নাচ । তার সজ্জার মধ্যেও লেশমাত্র উলঙ্গতা নেই। অন্য দেশের নাচে দেহের সৌন্দর্যলীলার সঙ্গে দেহের লালসা মিশ্রিত । এখানে নাচের কোনো ভঙ্গির মধ্যে লালসার ইশারামাত্র দেখা গেল না । আমার কাছে তার প্রধান কারণ এই বোধ হয় যে, সৌন্দর্যপ্ৰিয়তা জাপানির মনে এমন সত্য যে তার মধ্যে কোনোরকমের মিশল তাদের দরকার হয় না এবং সহ্য হয় না । কিন্তু, এদের সংগীতটা আমার মনে হল বড়ো বেশি দূর এগোয় নি। বোধ হয় চোখ আর কান, এই দুইয়ের উৎকর্ষ একসঙ্গে ঘটে না । মনের শক্তিস্রোত যদি এর কোনো একটা রাস্তা দিয়ে অত্যন্ত বেশি আনাগোনা করে তা হলে অন্য রাস্তাটায় তার ধারা অগভীর হয় । ছবি জিনিসটা হচ্ছে অবনীর, গান জিনিসটা গগনের । অসীম যেখানে সীমার মধ্যে সেখানে ছবি ; অসীম যেখানে সীমাহীনতায় সেখানে গান । রাপরাজ্যের কলা ছবি, অপরাপ রাজ্যের কলা গান । কবিতা উভচর, ছবির মধ্যেও চলে, গানের মধ্যেও ওড়ে । কেননা, কবিতার উপকরণ হচ্ছে ভাষা । ভাষার একটা দিকে অর্থ, আর-একটা দিকে সুর ; এই অর্থের যোগে ছবি গড়ে ওঠে, সুরের যোগে গান । - জাপানি রূপরাজ্যের সমস্ত দখল করেছে। যা-কিছু চোখে পড়ে। তার কোথাও জাপানির আলস্য নেই, অনাদর নেই ; তার সর্বত্রই সে একেবারে পরিপূর্ণতার সাধনা করেছে। অন্য দেশে গুণী এবং