পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৭৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8VO রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী রস চায় না, মদ চায় ; আনন্দ চায় না, আমোদ চায়। চিত্তের জাগরণটা তাদের কাছে শূন্য, তারা চায় চমকলগা । ভিড়ের ঠেলা ঠেলির মধ্যে অন্যমনস্কের মন যদি কাব্যকে গানকে পেতে হয় তা হলে তার খুব আড়ম্বরের ঘটা করা দরকার। কিন্তু, সে আড়ম্বরে শ্রোতার কানটাকেই পাওয়া যায় মাত্র, ভিতরের রসের কথাটা আরো বেশি করে ঢাকাই পড়ে । কারণ, সরলতা স্বচ্ছতা আর্টের যথার্থ আভরণ । যেখানে কোলাহল বেশি, ভিড় বৃহৎ, মন নানা-কিছুতে বিক্ষিপ্ত, আর্ট সেখানে কসরত দেখাবার প্রলোভনে মজে, আপনাকে দেখাতে ভুলে যায় । আড়ম্বর জিনিসটা একটা চীৎকার ; যেখানে গোলমালের অন্ত নেই। সেখানে তাকে গোচর হয়ে ওঠবার জন্যে চীৎকার করতে হয় ; সেই চীৎকারটাকেই ভিড়ের লোক শক্তির লক্ষণ জেনে পুলকিত হয়ে ওঠে। কিন্তু, আর্ট তো চীৎকার নয়, তার গভীরতম পরিচয় হচ্ছে তার আত্মসংবরণে । আট বরঞ্চ ঠেলা খেয়ে চুপ করে যেতে রাজি আছে, কিন্তু ঠেলা মেরে পালোয়ানি করার মতো লজা তার আর নেই । হায় রে লোকের মন, তোমাকে খুশি করবার জন্যে রামচন্দ্র একদিন সীতাকে বিসর্জন দিয়েছিলেন ; তোমাকে ভোলাবার জন্যেই আর্ট আজ। আপনার শ্ৰী ও হী বিসর্জন দিয়ে নৃত্য ভুলে পায়তারা মেরে বেড়াচ্ছে । ৩রা অক্টোবর ১৯২৪ এখনো সূর্য ওঠে নি । আলোকের অবতরণিকা পূর্ব আকাশে । জল স্থির হয়ে আছে সিংহবাহিনীর পায়ের তলাকার সিংহের মতো । সূর্যোদয়ের এই আগমনীর মধ্যে মজে গিয়ে আমার মুখে হঠাৎ ছন্দে-গাথা এই কথাটা আপনিই ভেসে উঠল-- হে ধরণী, কেন প্ৰতিদিন তৃপ্তিহীন একই লিপি পড় বারে বারে । বুঝতে পারলুম। আমার কোনো-একটি আগন্তুক কবিতা মনের মধ্যে এসে পৌঁছবার আগেই তার ধুয়োটা এসে পৌঁচেছে । এইরকমের ধুয়ো অনেক সময়ে উড়ো বীজের মতো মনে এসে পড়ে, কিন্তু সব সময়ে তাকে এমন স্পষ্ট করে দেখতে পাওয়া যায় না । সমুদ্রের দূর তীরে যে ধরণী, আপনার নানা-রঙ আঁচলখনি বিছিয়ে দিয়ে পুবের দিকে মুখ করে একলা বসে আছে, ছবির মতো দেখতে পেলুম, তার কোলের উপর একখানি চিঠি পড়লা খসে কোন উপরের থেকে । সেই চিঠিখানি বুকের কাছে তুলে ধরে সে একমনে পড়তে বসে গেল ; তলতমালের নিবিড় বনচ্ছায়া পিছনে রইল এলিয়ে, নুয়ে-পড়া মাথার থেকে ছড়িয়ে-পড়া এলোচুল । আমার কবিতার ধুয়ো বলছে, প্রতিদিন সেই একই চিঠি । সেই একখানির বেশি আর দরকার নেই ; সেই ওর যথেষ্ট । সে এত বড়ো, তাই সে এত সরল । সেই একখানিতেই সব আকাশ এমন সহজে ভরে গেছে । ধরণী পাঠ করছে কত যুগ থেকে । সেই পাঠ-করাটা আমি মনে মনে চেয়ে দেখছি। সুরলোকের বাণী পৃথিবীর বুকের ভিতর দিয়ে, কষ্ঠের ভিতর দিয়ে, রূপে রূপে বিচিত্র হয়ে উঠল। বনে বনে হল গাছ, ফুলে ফুলে হল গন্ধ, প্ৰাণে প্ৰাণে হল নিশ্বসিত । একটি চিঠির সেই একটি মাত্ৰ কথা, সেই আলো । সেই সুন্দর, সেই ভীষণ ; সেই হাসির ঝিলিকে ৰিকিমিকি, সেই কান্নার কাপনে ছলছল । এই চিঠি-পড়াটাই সৃষ্টির স্রোত ; যে দিচ্ছে আর যে পাচ্ছে সেই দুজনের কথা এতে মিলেছে, সেই মিলনেই রূপের ঢেউ । সেই মিলনের জায়গাটা হচ্ছে বিচ্ছেদ । কেননা, দূর-নিকটের ভেদ না ঘটলে স্রোত বয় না, চিঠি চলে না । সৃষ্টি-উৎসের মুখে কী-একটা কাণ্ড আছে, সে এক ধারাকে দুই-ধারায় ভাগ করে । বীজ ছিল নিতান্ত এক, তাকে দ্বিধা করে দিয়ে দুখানি কচি পাতা বেরল, তখনই সেই বীজ