পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৮৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

যাত্রী 8 Գ ֆ জানিবার ও ভাববার মতো তার সময়ও নেই শ্রদ্ধাও নেই। তাই যখনই দেখে দরোয়ানির ব্যবস্থা কঠোরতম করা হচ্ছে তখনই মুনফা-বৎসলেরা পুলকিত হয়ে ওঠে । ল অ্যান্ড অর্ডার রক্ষা হচ্ছে দরোয়ানিতন্ত্র, পালোয়ানের পালা ; সিমপ্যাথি অ্যান্ড রেসপেকটু হচ্ছে ধর্মতন্ত্র, মানুষের নীতি । অবিচার করতে চাই নে, রাজ্যশাসন মাত্রেই ল অ্যান্ড অর্ডার চাই । নিতান্ত মেহপ্রেমের এলাকাতেও কানমলার বরাদ্দ থাকে। রাজ্যে ছটুফটানি বৃদ্ধি হলে সাধারণ দণ্ডবিধি অসাধারণ অবৈধ হয়ে উঠলেও দোষ দিই নে। একপক্ষে দুরন্তাপনা ঘটলে অন্যপক্ষে দৌরাত্ম্য ঘটা শক্তিমানের পক্ষে গৌরবের বিষয় না হলেও সেটাকে স্বাভাবিক বলে মেনে নেওয়া যেতে পারে । আসল কথা, কোনো শাসনতন্ত্রকে বিচার করতে হলে সমগ্র রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রকৃতি বিচার করা চাই । যদি দেখা যায়, দেশের সকল মহলেই দরোয়ানের ঠেসাঠেসি ভিড়, অথচ তৃষ্ণায় যখন ছাতি ফাটছে, ম্যালেরিয়ায় যখন নাড়ী ছেড়ে যায়, তখন জনপ্রাণীর সাড়া নেই— যখন দেখি দরোয়ানের তকমা শিরোপা বকশিশ বাহবা সম্বন্ধে দক্ষিণ্যের অজস্রতা, কোতোয়ালি থেকে শুরু করে দেওয়ানি ফৌজদারি কোনো বিভাগের কারও দুঃখ গায়ে সয় না, কারও আবদার ব্যর্থ হতে চায় না। অথচ ঘরের ছেলের প্রাণ যখন কণ্ঠাগত৷ তখন আত্মনির্ভর সম্বন্ধে সৎপরামর্শ ছাড়া আর কোনো কথা নেই- অর্থাৎ গলায় যখন ফাস তখন দুৰ্গানাম স্মরণ করা ছাড়া আর কোনো উপদেশ যেখান থেকে মেলে না। সেখানে পরিমাণের অসংগতিতেই দরোয়ানটাকে যমদূত বলে সহজেই মনে হয়। যে পাকা বাড়িটাতে সুহৃদ সহায় আত্মীয়ের চেয়ে পাহারাওয়ালার প্রভাবই বেশি সেই জায়গাটিকেই তো চলতি ভাষায় জেলখানা বলে থাকে । বাগানে তো ইচ্ছে করেই লোকে কাটােগাছের বেড়া দেয়, সে কি আমরা জানি নে । কিন্তু, যেখানে কঁাটাগাছেরই যত আদর, ফুলগাছ শুকিয়ে মরে গেল, সে-বাগানে আমাদের মনে যদি উৎসাহ না হয় তা হলে মালী সেটাকে আমাদের অবিবেচনা মনে করে কেন। যদি শাসনকর্তা জিজ্ঞাসা করেন “তোমরা কি চাও না দেশে ল অ্যান্ড অর্ডার থাকে”, আমি বলি, “খুবই চাই, কিন্তু লাইফ অ্যান্ড মাইন্ড তার চেয়ে কম মূল্যবান নয়।” মানদণ্ডের একটা পাল্লায় বিশ পঁচিশ মণ বাটখারা চাপানো দোষের নয়, অন্য পাল্লাটাতে যে-মাল চাপানো হয় তাতে যদি আমাদের নিজের স্বত্ব কিছু থাকে । কিন্তু যখন দেখি এ-পক্ষের দিকটাতেই যত রাজ্যের ইটপাথর, আর মালের পনেরো আনাই হল অন্য পক্ষের দিকে, তখন ফৌজে-পুলিসে-গড়া মানদণ্ডটা অপমানদণ্ড বলেই ঠেকে । নালিশ আমাদের পুলিসের বিরুদ্ধে নয়, নালিশ আমাদের এই ওজনের বিরুদ্ধে ; নালিশ- আগুন জ্বলে বলে নয়, রান্না চড়ানো হয় না। বলে । বিশেষত, সেই আগুনের বিল যখন আমাদেরই চোকাতে হয় । চুলিতে কাঠের খরচটাই এত সর্বনেশে হয়ে ওঠে যে হাড়িতে চাল ডাল জোগাবার কড়ি বাকি থাকে না । সেই অবস্থায় যখন পেটের জ্বালায় চোখে জল আসে তখন যদি কর্তা রাগ করে বলেন, “তবে কি চুলোতে আগুন জ্বালব না”, ভয়ে ভয়ে বলি, “জ্বালবে বৈকি, কিন্তু ওটা-যে চিতার আগুন হয়ে উঠল ।” যে-দুঃখের কথাটা বলছি। এটা জগৎ জুড়ে আজ ছড়িয়ে পড়েছে ; আজ মুনাফার আড়ালে মানুষের জ্যোতির্ময় সত্য রাহুগ্ৰস্ত । এইজন্যই মানুষের প্রতি কঠিন ব্যবহার করা, তাকে বঞ্চনা করা, এত সহজ হল। তাই পাশ্চাত্যে পলিটিকসই মানুষের সকল চেষ্টার সর্বোচ্চ চুড়া দখল করে বসেছে। অর্থাৎ, মানুষের ফুলে-ওঠা পকেটের তলায় মানুষের চুপসে-যাওয়া হৃদয় পড়েছে চাপা । সর্বভুক, পেটুকতার এমন বিস্তৃত আয়োজন পৃথিবীর ইতিহাসে আর কোনোদিন এমন কুৎসিত আকারে দেখা দেয় নি। 하 আমাদের রিপু সত্যের সম্পূর্ণ মূর্তিকে আচ্ছন্ন করে। কামে আমরা মাংসই দেখি, আত্মাকে দেখি নে ; লোভে আমরা বস্তুই দেখি, মানুষকে দেখি নে ; অহংকারে আমরা আপনাকেই দেখি, অন্যকে দেখি নে । একটা রিপু আছে যা এদের মতো উগ্র নয়, যা ফাকা । তাকে বলে মোহ ; সে হচ্ছে জড়তা,