পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫১৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

জাভা যাত্রীর পত্ৰ S কল্যাণীয়াসু যাত্রা যখন আরম্ভ করা গেল আকাশ থেকে বর্ষার পদ তখন সরিয়ে দিয়েছে : সূর্য আমাকে অভিনন্দন করলেন । কলকাতা থেকে মাদ্রাজ পর্যন্ত যতদূর গেলুম রেলগাড়ির জানলা দিয়ে চেয়ে চেয়ে মনে হল, পৃথিবীতে সবুজের বান ডেকেছে ; শ্যামলের বঁাশিতে তানের পর তান লাগছে, তার আর বিরাম নেই। খেতে খেতে নতুন ধানের অকুরে কাচা রং, বনে বনে রসপরিপুষ্ট প্রচুর পল্লবের ঘন সবুজ । ধরণীর বুকের থেকে অহল্যা জেগে উঠেছেন ; নবদুর্বদলশ্যাম রামচন্দ্রের পায়ের স্পর্শ क्लांकन । প্রকৃতির এই নব জীবনের উৎসবে রূপের উত্তরে রসের গান গাবার জন্যেই আমি এসেছিলুম ; এই কথাই কেবল মনে পড়ে। কাজের লোকেরা জিজ্ঞাসা করে, তার দরকার কী । বলে, ওটা শৌখিনতা । অর্থাৎ এই প্রয়োজনের সংসারে আমরা বাহুল্যর দলে । তাতে লজ্জা পাব না । কেননা, এই বাহুল্যের দ্বারাই আত্মপরিচয় । হিসাবি লোকেরা একটা কথা বার বার ভুলে যায় যে, প্রচুরের সাধনাতেই প্রয়োজনের সিদ্ধি ; এই আষাঢ়ের পৃথিবীতে সেই কথাটাই জানালো। আমি চাই ফসল, যেটুকুতে আমার পেট ভরবে। সেই স্বল্প প্রত্যাশাকে মূর্তিমান দেখি তখনই যখন বর্ষণে অভিষিক্ত মাটির ভাণ্ডারে শ্যামল ঐশ্বৰ্য আমার প্রয়োজনকে অনেক বেশি ছাপিয়ে পড়ে। মুষ্টিভিক্ষাও জোটে না যখন ধনের সংকীর্ণতা সেই মুষ্টিকে না ছাড়িয়ে যায়। প্রাণের কারবারে প্রাণের মুনফাটাই লক্ষ্য, এই মুনফাটাই বাহুল্য । আমাদের সন্ন্যাসী মানুষেরা এই বাহুল্যাটাকে নিন্দা করে ; এই বাহুল্যকেই নিয়ে কবিদের উৎসব । খরচপত্র বাদেও যথেষ্ট উদ্যবৃত্ত যদি থাকে। তবেই সাহস করে খরচপত্র চলে, এই কথাটা মানি বলে আমরা মুনফগ চাই। সেটা তাতেই মানুষকে কৃতাৰ্থ করে। বর্তমান যুগে যুরোপেই মানুষকে দেখি যার প্রাণের মূনাফা নানা খাতায় কেবলই বেড়ে চলেছে। এইজন্যেই পৃথিবীতে এত ঘটা করে সে আলো জ্বালল। সেই আলোতে সে সকল দিকে প্রকাশমান । অল্প তেলে কেবল একটি মাত্র প্রদীপে ঘরের কাজ চলে যায়, কিন্তু পুরো মানুষটা তাতে অপ্রকাশিত থাকে । এই অপ্ৰকাশ অস্তিত্বের কাপণ্য, কম করে থাকা । এটা মানবসত্যের অবসাদ । জীবলোকে মানুষরা জ্যোতিষ্কজাতীয় ; জন্তুরা কেবলমাত্র বেঁচে থাকে, তাদের অস্তিত্ব দীপ্ত হয়ে ওঠে নি। কিন্তু, মানুষ কেবল-যে আত্মরক্ষা করবে তা নয়, সে আত্মপ্রকাশ করবে। এই প্রকাশের জন্যে আত্মার দীপ্তি চাই । অস্তিত্বের প্রাচুর্য থেকে, অস্তিত্বের ঐশ্বৰ্য থেকেই এই দীপ্তি। বর্তমান যুগে যুরোপই সকল দিকে আপনার রশ্মি বিকীর্ণ করেছে ; তাই মানুষ সেখানে কেবল-যেটিকে আছে তা নয়, টিকে থাকার চেয়ে আরো অনেক বেশি করে আছে। পর্যাপ্তে চলে আত্মরক্ষা, অপর্যাপ্তে আত্মপ্রকাশ । যুরোপে জীবন অপৰ্যাপ্ত । এটাতে আমি মনে দুঃখ করি নে। কারণ, যে-দেশেই যে-কালেই মানুষ কৃতাৰ্থ হােক-না কেন, সকল দেশের সকল কালের মানুষকেই সে কৃতাৰ্থ করে। যুরোপ আজ প্রাণপ্রাচুর্যে সমস্ত পৃথিবীকেই