পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫২৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

যাত্রী ○ ○。 কথাটা একটু ভেবে-দেখবার । কালিদাসের মেঘদূত মানবসাধারণের জন্যেই লেখা, আজ তার প্ৰমাণ হয়ে গেছে । যদি কোনো বিশিষ্ট দলের জন্যে লেখা হত তা হলে সে দলও থাকত না। আর মেঘদূতও যেত তারই সঙ্গে অনুমরণে। কিন্তু, এখন যাকে পাবলিক বলছি কালিদাসের সময় সেই পাবলিক অত্যন্ত গা-ঘেষা হয়ে শ্রোতারাপে ছিল না । যদি থাকত তা হলে যে-মানবসাধারণ শত শত বৎসরের মহাক্ষেত্রে সমাগত তাদের পথ তারা অনেকটা পরিমাণে আটকে দিত । এখনকার পাবলিক একটা বিশেষ কালের দানাবাধা সর্বসাধারণ । তার মধ্যে খুব নিরেট হয়ে তাল-পাকিয়ে আছে এখনকার কালের রাষ্ট্রনীতি, সমাজনীতি, ধমনীতি, এখনকার কালের বিশেষ রুচি প্ৰবৃত্তি এবং আরো কত কী । এই সর্বসাধারণ যে মানবসাধারণের প্রতিরূপ, তা বলা চলবে না । এর ফরমাশ যে একশো বছর পরের ফরম্যাশের সঙ্গে মিলবে না, সে কথা জোর করেই বলতে পারি । কিন্তু, এই উপস্থিতকালের সর্বসাধারণ কানের খুব কাছে এসে জোর গলায় দুয়ো দিচ্ছে, বাহবা দিচ্ছে । উপস্থিতকালের সংকীর্ণ পরিধির তুলনাতেও এই দুয়ো-বাহবার স্থায়িত্ব অকিঞ্চিৎকর । পাবলিক-মহারাজ আজ দুই চোখ লাল করে যে-কথাটাকে প্ৰত্যাখ্যান করেছে, আসছে-কাল সেইটোকেই এমনি চড়া গলায় ব্যবহার করে যেন সেটা তার নিজেরই চিরকালের চিন্তিত কথা । আজ যে কথা শুনে তার দুই গাল বেয়ে চোখের জল বয়ে গেল, আসছে-কাল সেটাকে নিয়ে হাসাহসি করবার সময় নিজের গদগদাচিত্তের পূর্ব ইতিহাসটি সম্পূর্ণ বে-কবুল যায় । ইংরেজ বেনের আপিসঘর-গুদামঘরের আশে-পাশে হঠাৎ যখন কলকাতা শহরটা মাথা ঝাড়া দিয়ে উঠল তখন সেখানে এই নতুন-গড়া দোকানপাড়ার এক পাবলিক দেখা দিলে । অন্তত, তার এক ভাগের চেহারা হুতুম পেচার নকশায় উঠেছে । তারই ফরম্যাশের ছাপ পড়েছে দাশুরায়ের পাচালিতে । ঘন ঘন অনুপ্রাস তপ্ত-খোলার উপরকার খইয়ের মতো পটুপটু শব্দে ফুটে ফুটে ফুলে ফুলে উঠতে व्ळ्ञ् নিতান্ত কৃতান্ত-ভয়ান্ত হবে ভাবে । চারি দিকে হায়-হায় শব্দে সভা তোলপাড় । দুই কানে হাত-চাপা, তারস্বরে দ্রুত লয়ে গান উঠল-- ওরে রে লক্ষ্মণ, এ কী অলক্ষণ, বিপদ ঘটেছে বিলক্ষণ । অতি নগণ্য কাজে, অতি জঘন্য সাজে ঘোর অরণ্য-মাঝে কত কঁাদিলাম। ইতাদি । দোকানপাড়ার জনসাধারণ খুশি হয়ে নগদ বিদায় করলে । অবকাশের সম্পদকে অবকাশের শিক্ষাযোগে ভোগ করবার শক্তি, যার ছিল না সেই ঈস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাটের পাবলিককে মাথা-গুনতির জোরে মানবসাধারণের প্রতিনিধি বলে মেনে নিতে হবে নাকি । বস্তুত, এই জনসাধারণই দাশুরায়ের প্রতিভাকে বিশ্বসাধারণের মহাসভায় উত্তীর্ণ হতে বাধা দিয়েছিল । অথচ, মৈমনসিং থেকে যে-সব গাথা সংগ্ৰহ করা হয়েছে তাতে সহজেই বেজে উঠছে। বিশ্বসাহিত্যের সুর । কোনো শহুরে পাবলিকের দ্রুত ফরম্যাশের ছাচে ঢালা সাহিত্য তো সে নয় । মানুষের চিরকালের সুখদুঃখের প্রেরণায় লেখা সেই গাথা । যদি-বা ভিড়ের মধ্যে গাওয়া হয়েও থাকে, তবু এ ভিড় বিশেষ কালের বিশেষ ভিড় নয় । তাই এ সাহিত্য সেই ফসলের মতো যা গ্রামের লোক আপন মাটির বাসনে ভোগ করে থাকে বটে। তবুও তা বিশ্বেরই ফসল- তা ধানের মঞ্জরী । যে-কবিকে আমরা কবি বলে সম্মান করে থাকি তার প্রতি সম্মানের মধ্যে এই সাধুবাদটুকু থাকে যে, তার একলার কথাই আমাদের সকলের কথা । এইজন্যেই কবিকে একলা বলতে দিলেই সে সকলের কথা সহজে বলতে পারে । হাটের মাঝখানে দাড়িয়ে সেইদিনকার হাটের লোকের মনের কথা যেমন-তেমন করে মিলিয়ে দিয়ে তাদের সেইদিনকার বহু-মুণ্ডের মাথা-নাড়া-গুনতির জোরে আমরা