পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৭৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

রাশিয়ার চিঠি @@为 এই-যে বিপ্লবটা ঘটল এটা রাশিয়াতে ঘটবে বলেই অনেক কাল থেকে অপেক্ষা করছিল । আয়োজন কত দিন থেকেই চলছে । খ্যাত-অখ্যাত কত লোক কত কাল থেকেই প্ৰাণ দিয়েছে, অসহ্য দুঃখ স্বীকার করেছে। পৃথিবীতে বিপ্লবের কারণ বহুদূর পর্যন্ত ব্যাপক হয়ে থাকে, কিন্তু এক-একটা জায়গায় ঘনীভূত হয়ে ওঠে । সমস্ত শরীরের রক্ত দূষিত হয়ে উঠলেও এক-একটা দুর্বল জায়গায় ফোড়া হয়ে লাল হয়ে ওঠে । যাদের হাতে ধন, যাদের হাতে ক্ষমতা, তাদের হাত থেকে নির্ধন ও অক্ষমেরা এই রাশিয়াতেই অসহ্য যন্ত্রণা বহন করেছে । দুই পক্ষের মধ্যে একান্ত অসাম্য অবশেষে প্ৰলয়ের মধ্যে দিয়ে এই রাশিয়াতেই প্ৰতিকারসাধনের চেষ্টায় প্রবৃত্ত । একদিন ফরাসী-বিদ্রোহ ঘটেছিল এই অসাম্যের তাড়নায় । সেদিন সেখানকার পীড়িতেরা বুঝেছিল এই অসাম্যের অপমান ও দুঃখ বিশ্বব্যাপী । তাই সেদিনকার বিপ্লবে সাম্য সৌভ্রাত্র ও স্বাতন্ত্র্যের বাণী স্বদেশের গণ্ডি পেরিয়ে উঠে ধবনিত হয়েছিল । কিন্তু টিকল না । এদের এখানকার বিপ্লবের বাণীও বিশ্ববাণী । আজ পৃথিবীতে অন্তত এই একটা দেশের লোক স্বজাতিক স্বার্থের উপরেও সমস্ত মানুষের স্বার্থের কথা চিন্তা করছে । এ বাণী চিরদিন টিকবে কি না কেউ বলতে পারে না । কিন্তু স্বজাতির সমস্যা সমস্ত মানুষের সমস্যার অন্তর্গত, এই কথাটা বর্তমান যুগের অন্তনিহিত কথা । একে স্বীকার করতেই হবে । এই যুগে বিশ্ব-ইতিহাসের রঙ্গভূমির পর্দা উঠে গেছে। এতকাল যেন আড়ালে আড়ালে রিহার্স্যাল চলছিল, টুকরো টুকরো ভাবে, ভিন্ন ভিন্ন কামরায় । প্রত্যেক দেশের চারি দিকে বেড়া ছিল । বাহির থেকে আনাগোনা করবার পথ একেবারে ছিল না তা নয়, কিন্তু বিভাগের মধ্যে মানবসংসারের যে চেহারা দেখেছি আজ তা দেখি নে । সেদিন দেখা যাচ্ছিল একটি- একটি গাছ, আজ দেখছি অরণ্য । মানবসমাজের মধ্যে যদি ভারসামঞ্জস্যের অভাব ঘটে থাকে সেটা আজ দেখা দিচ্ছে পৃথিবীর এক দিক থেকে আর-এক দিক পর্যন্ত । এমন বিরাট করে দেখতে পাওয়া কম কথা নয় । টােকিয়োতে যখন কোরীয় যুবককে জিজ্ঞাসা করেছিলুম “তোমাদের দুঃখটা কী” সে বললে, “আমাদের কাধে চেপেছে মহাজনের রাজত্ব, আমরা তাদের মুনাফার বাহন ।” আমি প্রশ্ন করলুম, যে কারণেই হোক, “তোমরা যখন দুর্বল তখন এই বোঝা নিজের জোরে ঝেড়ে ফেলবে কী উপায়ে ।” সে বললে, নিরুপায়ের দল আজ পৃথিবী জুড়ে, দুঃখে তাদের মেলাবে- যারা ধনী, যারা শক্তিমান, তারা নিজের নিজের লোহার সিন্ধুক ও সিংহাসনের চার দিকে পৃথক হয়ে থাকবে, তারা কখনো মিলতে পারবে না । কোরিয়ার জোর হচ্ছে তার দুঃখের জোর ।* দুঃখী আজ সমস্ত মানুষের রঙ্গভূমিতে নিজেকে বিরাট করে দেখতে পাচ্ছে, এইটো মস্ত কথা । আগেকার দিনে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে দেখেছে বলেই কোনোমতে নিজের শক্তিরােপ দেখতে পায় নি- অদৃষ্টের উপর ভর করে সব সহ্য করেছে । আজ অত্যন্ত নিরুপায়ও অন্তত সেই স্বৰ্গরাজ্য কল্পনা করতে পারছে যে রাজ্যে পীড়িতের পীড়া যায়, অপমানিতের অপমান ঘোচে । এই কারণেই সমস্ত পৃথিবীতেই আজ দুঃখজীবীরা নড়ে উঠেছে। - যারা শক্তিমান তারা উদ্ধত । দুঃখীদের মধ্যে আজ যে শক্তির প্রেরণা সঞ্চারিত হয়ে তাদের অস্থির করে তুলেছে তাকে বলশালীরা বাইরে থেকে ঠেকাবার চেষ্টা করছে- তার দূতদের ঘরে ঢুকতে দিচ্ছে না, তাদের কণ্ঠ দিচ্ছে রুদ্ধ করে । কিন্তু আসল যাকে সব চেয়ে ওদের ভয় করা উচিত ছিল সে হচ্ছে দুঃখীর দুঃখ- কিন্তু তাকেই এরা চিরকাল সব চেয়ে অবজ্ঞা করতে অভ্যন্ত । নিজের মুনফার খাতিরে সেই দুঃখকে এরা বাড়িয়ে চলতে ভয় পায় না, হতভাগ্য চাষীকে দুর্ভিক্ষের কবলের মধ্যে ঠেসে ধরে। শতকরা দুশো তিনশো হারে মুনফগ ভোগ করতে এদের হৎকম্প হয় না । কেননা সেই মুনফাকেই এরা শক্তি বলে জানে। কিন্তু মানুষের সমাজে সমস্ত আতিশয্যের মধ্যেই বিপদ, সে বিপদকে কখনোই বাইরে থেকে ঠেকানো যায় না । অতিশয় শক্তি অতিশয় অশিক্তির বিরুদ্ধে চিরদিন নিজেকে বাড়িয়ে ১ দ্রষ্টব্য পরিশিষ্ট : কোরীয় যুবকের রাষ্টিক মত