পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৬৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

মানুষের ধর্ম ఆరిసి জন্যে গুহার দ্বার আগলিয়ে রইল । চল্লিশজন ছুরি আস্ফালন করে তাদের আক্রমণ করতে উদ্যত, মালিক তাদের ঠেকিয়ে রাখলে । তখনো উপর থেকে বোমা পড়ছে, ভিড়ের লোক ঠেলা ঠেলি করছে গুহায় আশ্রয় নেবার জন্যে । নিকটবতী স্থানের অন্য কয়েকজন মালিক এবং একজন মোল্লা এদের আনুকূল্যে প্রবৃত্ত হল । মেয়েরা কেউ কেউ নিলে এদের আহারের ভার। অবশেষে কিছুদিন পরে - মাহসুদের ছদ্মবেশ পরিয়ে এরা তাদের নিরাপদ স্থানে পৌছিয়ে দিল । এই ঘটনার মধ্যে মানবস্বভাবের দুই বিপরীত দিক চূড়ান্তভাবেই দেখা দিয়েছে । এরোপ্লেন থেকে বোমাবর্ষণে দেখা যায় মানুষের শক্তির আশ্চর্য সমৃদ্ধি, ভূতল থেকে নভস্তল পর্যন্ত তার সশস্ত্ৰ বাহুর বিপুল বিস্তার। আবার হননে-প্রবৃত্ত শক্রকে ক্ষমা করে তাকে রক্ষা করতে পারল, মানুষের এই আর-এক পরিচয় । শক্রহননের সহজ প্রবৃত্তি মানুষের জীবধর্মে, তাকে উত্তীর্ণ হয়ে মানুষ অদ্ভুত কথা বললে, “শক্রকে ক্ষমা করো ।” এ কথাটা জীবধর্মের হানিকর, কিন্তু মানবধর্মের উৎকর্ষলক্ষণ । আমাদের ধর্মশাস্ত্রে বলে, যুদ্ধকালে যে মানুষ রথে নেই, যে আছে ভূতলে, রথী। তাকে মারবে না ! যে ক্লাব, যে কৃতাঞ্জলি, যে মুক্তকেশ, যে আসীন, যে সানুনয়ে বলে “আমি তোমারই, তাকেও মারবে না । যে ঘুমাচ্ছে, যে বর্মহীন, যে নগ্ন, যে নিরস্ত্র, যে অযুধ্যমান, যে যুদ্ধ দেখছে মাত্র, যে অন্যের সঙ্গে যুদ্ধে প্ৰবৃত্ত, তাকেও মারবে না । যার অস্ত্ৰ গেছে ভেঙে, যে শোকার্ত, যে পরিক্ষত, যে ভীত, যে পরাবৃত্ত, সতের ধর্ম অনুসরণ করে তাকেও মারবে না । সত্যের ধর্ম বলতে বোঝায় মানুষের মধ্যে যে সত্য তারই ধর্ম, মানুষের মধ্যে যে মহৎ তারই ধর্ম । যুদ্ধ করতে গিয়ে মানুষ যদি তাকে অস্বীকার করে তবে ছােটাে দিকে তার জিত হলেও বড়ো দিকে তার হার । উপকরণের দিকে তার সিদ্ধি, অমৃতের দিকে সে বঞ্চিত ; এই অমৃতের আদর্শ মাপজোখের বাইরে । স্বৰ্ণলঙ্কার মাপজোখ চলে । দশাননের মুণ্ড ও হাত গণনা করে বিস্মিত হবার কথা । তার অক্ষৌহিণী সেনারাও সংখ্যা আছে, জয়বিস্তারের পরিধি-দ্বারা সেই সেনার শক্তিও পরিমেয় । আত্মার মহিমার পরিমাণ নেই । শক্রকে নিধনের পরিমাপ আছে, শক্রকে ক্ষমার পরিমাপ নেই । আত্মা যে মহাৰ্ঘতায় আপন পরিচয় দেয় ও পরিচয় পায় সেই পরিচয়ের সত্য কি বিরাজ করে না অপরিমেয়ের মধ্যে, যাকে অথৰ্ববেদ বলেছেন সকল সীমার উদ্যবৃত্ত, সকল শেষের উৎশেষ । সে কি এমন একটি স্বয়ম্ভব বুদবুদ কোনাে সমুদ্রের সঙ্গে যার কোনো যোগ নেই। মানুষের কাছে শুনেছি, ন পাপে প্ৰতিপাপঃ স্যাৎ— তোমার প্রতি পাপ যে করে তার প্রতি ফিরে পাপ কোরো না । কথাটাকে ব্যবহারে ব্যক্তিবিশেষ মানে বা নাই মানে, তবু মন তাকে পাগলের প্রলাপ বলে হেসে ওঠে না । মানুষের জীবনে এর স্বীকৃতি দৈবাৎ দেখি, প্ৰায় দেখি বিরুদ্ধতা, অর্থাৎ মাথা গনতি করে এর সত্য চোখে পড়ে না। বললেই হয় । তবে এর সত্যতা কোনখানে । মানুষের যে স্বভাবে এটা আছে তার আশ্রয় কোথায় । মানুষ এ প্রশ্নের কী উত্তর দিয়েছে শুনি । যস্যাত্মা বিরতঃ পাপাৎ কল্যাণে চ নিবেশিতঃ তেন সর্বমিদং বুদ্ধং প্রকৃতিবিকৃতিশাচ যা । আত্মা যার পাপ থেকে বিরত ও কল্যাণে নিবিষ্ট তিনি সমস্তকে বুঝেছেন । তাই তিনি জানেন কোনটা স্বভাবসিদ্ধ, কোনটা স্বভাববিরুদ্ধ । মানুষ আপনার স্বভাবকে তখনই জানে যখন পাপ থেকে নিবত্ত হয়ে কল্যাণের অর্থাৎ সর্বজনের হিতসাধনা করে । অর্থাৎ মানুষের স্বভাবকে জানে মানুষের মধ্যে যারা মহাপুরুষ । জানে কী করে । তেন সর্বমিদং বুদ্ধম । স্বচ্ছ মন দিয়ে সমস্তটাকে সে বোঝে । সত্য আছে, শিব আছে সমগ্রের মধ্যে । যে পাপ অহংসীমাবদ্ধ স্বভাবের তার থেকে বিরত হলে তবে মানুষ আপনার আত্মিক সমগ্রকে জানে, তখনই জানে আপনার প্রকাতি । তার এই প্ৰকতি কেবল আপনাকে নিয়ে নয়, তাকেই নিয়ে র্যাকে গীতা বলছেন : তিনিই পৌরুষং নৃষ্ণু, মানুষের মধ্যে মনুষ্যত্ব । মানুষ এই পৌরুষের প্রতিই লক্ষ