পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৮৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

মানুষের ধর্ম VoGS বিশ্বদেবতা আছেন, তার আসন লোকে লোকে, গ্ৰহচন্দ্ৰতারায় । জীবনদেবতা বিশেষভাবে জীবনের আসনে, হৃদয়ে হৃদয়ে তার পীঠস্থান সকল অনুভূতি, সকল অভিজ্ঞতার কেন্দ্রে । বাউল তাকেই বলেছে মনের মানুষ । এই মনের মানুষ, এই সর্বমানুষের জীবনদেবতার কথা বলবার চেষ্টা করেছি “Religion of Man" TooefeОe i GeofеG и-fos কোঠায় ফেললে ভুল হবে । তাকে মতবাদের একটা আকার দিতে হয়েছে, কিন্তু বস্তুত সে কবিচিত্তের একটা অভিজ্ঞতা। এই আন্তরিক অভিজ্ঞতা অনেককাল থেকে ভিতরে ভিতরে আমার মধ্যে প্রবাহিত ; তাকে আমার ব্যক্তিগত চিত্তপ্রকৃতির একটা বিশেষত্ব বললে তাই আমাকে মেনে নিতে হবে । ষিনি সর্বজগদগত ভূমা তাকে উপলব্ধি করবার সাধনায় এমন উপদেশ পাওয়া যায় যে, “লোকালয় ত্যাগ করো, গুহাগহবরে যাও, নিজের সত্তাসীমাকে বিলুপ্ত করে অসীমে অন্তহিত হও ।” এই সাধনা সম্বন্ধে কোনো কথা বলবার অধিকার আমার নেই । অন্তত, আমার মন যে সাধনাকে স্বীকার করে তার কথাটা হচ্ছে এই যে, আপনাকে ত্যাগ না করে আপনার মধ্যেই সেই মহান পুরুষকে উপলব্ধি করবার ক্ষেত্র আছে— তিনি নিখিল মানবের আত্মা । তাকে সম্পূর্ণ উত্তীর্ণ হয়ে কোনো অমানব বা অতিমানব সত্যে উপনীত হওয়ার কথা যদি কেউ বলেন। তবে সে কথা বোঝবার শক্তি আমার নেই । কেননা, শোধন করি, তা মানবচিত্ত কখনোই ছাড়াতে পারে না । আমরা যাকে বিজ্ঞান বলি তা মানববুদ্ধিতে প্রমাণিত বিজ্ঞান, আমরা যাকে ব্ৰাহ্মানন্দ বলি তাও মানবের চৈতন্যে প্রকাশিত আনন্দ । এই বুদ্ধিতে, এই আনন্দে র্যাকে উপলব্ধি করি তিনি ভুমা, কিন্তু মানবিক ভূমা । তার বাইরে অন্য কিছু থাকা না-থাকা মানুষের পক্ষে সমান । মানুষকে বিলুপ্ত করে যদি মানুষের মুক্তি, তবে মানুষ হলুম কেন । একসময় বসে বসে প্রাচীন মন্ত্রগুলিকে নিয়ে ঐ আত্মবিলায়ের ভাবেই ধ্যান করেছিলুম। পালাবার ইচ্ছে করেছি, শান্তি পাই নি তা নয় । বিক্ষোভের থেকে সহজেই নিকৃতি পাওয়া যেত। এ ভাবে দুঃখের সময় সাত্মনা পেয়েছি। প্রলোভনের হাত থেকে এমনি ভাবে উদ্ধার পেয়েছি। আবার এমন একদিন এল যেদিন সমস্তকে স্বীকার করলুম, সবকে গ্রহণ করলুম। দেখলুম, মানবনাট্যমঞ্চের মাঝখানে যে লীলা তার অংশের অংশ আমি । সব জড়িয়ে দেখলুম। সকলকে । এই-যে দেখা একে ছোটাে বলব না । এও সত্য । জীবনদেবতার সঙ্গে জীবনকে পৃথক করে দেখলেই দুঃখ, মিলিয়ে দেখলেই মুক্তি ।