१२७ রবীন্দ্র-রচনাবলী ভারতবর্ষ সমাজকে সংযত সরল করিয়া তুলিয়াছিল, তাহা সমাজের মধ্যেই আবদ্ধ হইবার জন্য নহে। নিজেকে শতধাবিভক্ত অন্ধ চেষ্টার মধ্যে বিক্ষিপ্ত না করিয়া, সে আপন সংহত শক্তিকে অনন্তের অভিমুখে একাগ্ৰ করিবার জন্যই ইচ্ছাপূর্বক বাহাবিষয়ে সংকীর্ণতা আশ্রয় করিয়াছিল। নদীর তাঁটবন্ধনের ন্যায় সমাজবন্ধন তাহাকে বেগদান করিবে, বন্দী করিবে না, এই তাহার উদ্দেশ্য ছিল। এইজন্য ভারতবর্ষের সমস্ত ক্রিয়াকর্মের মধ্যে, সুখশান্তিসন্তোষের মধ্যে মুক্তির আহবান আছে- আত্মাকে ভূমানন্দে ব্রহ্মের মধ্যে বিকশিত করিয়া তুলিবার জন্যই সে সমাজের মধ্যে আপন শিকড় বাধিয়াছিল। যদি সেই লক্ষ্য হইতে ভ্ৰষ্ট হই, জড়ত্ববশত সেই পরিণামকে উপেক্ষা করি, তবে বন্ধন কেবল বন্ধনই থাকিয়া যায়, তবে অতিক্ষুদ্র সন্তোষশান্তির কোনো অর্থই থাকে না। ভারতবর্ষের লক্ষ্য ক্ষুদ্র নহে, তাহা ভারতবর্ষ স্বীকার করিয়াছে— ভূমৈব সুখং নাল্পে সুখমস্তি। ভূমাই সুখ, অল্পে সুখ নাই। ভারতের ব্ৰহ্মবাদিনী বলিয়াছেন; যেনাহং নামৃত স্যাং কিমহং তেন। কুর্যম। যাহার দ্বারা অমর না হইব তাহা লইয়া আমি কী করিব ? কেবলমাত্র পারিবারিক শৃঙ্খলা এবং সামাজিক সুব্যবস্থার দ্বারা আমি অমর হইব না, তাহাতে আমার আত্মার বিকাশ হইবে না। সমাজ যদি আমাকে সম্পূর্ণ সার্থকতা না দেয়, তবে সমাজ আমার কে ? সমাজকে রাখিবার জন্য যে আমাকে বঞ্চিত হইতে হইবে, এ কথা স্বীকার করা যায় না। যুরোপও বলে, individual কে যে সমাজ পঙ্গু ও প্রতিহত করে সে সমাজের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ না করিলে হীনতা স্বীকার করা হয়। ভারতবর্ষও অত্যন্ত অসংকোচে নিৰ্ভয়ে বলিয়াছে, আত্মার্থে পৃথিবীং ত্যজেৎ। সমাজকে মুখ্য করিলে উপায়কে উদ্দেশ্য করা হয়। ভারতবর্ষ তাহা করিতে চাহে নাই, সেইজন্য তাহার বন্ধন যেমন দৃঢ় তাহার ত্যাগও সেইরূপ সম্পূর্ণ। সাংসারিক পরিপূর্ণতার মধ্যে ভারতবর্ষ আপনাকে বেষ্টিত বদ্ধ করিত না, তাহার বিপরীতই করিত। যখন সমস্ত সঞ্চিত হইয়াছে, ভাণ্ডার পূর্ণ হইয়াছে, পুত্র বয়ঃপ্রাপ্ত হইয়া বিবাহ করিয়াছে, যখন সেই পূৰ্ণপ্রতিষ্ঠিত সংসারের মধ্যে আরাম করিবার- ভোগ করিবার— অবসর উপস্থিত হইয়াছে ঠিক সেই সময়েই সংসার পরিত্যাগের ব্যবস্থা; যতদিন খাটুনি ততদিন তুমি আছ, যখন খাটুনি বন্ধ তখন আরামে ফলভোগের দ্বারা জড়ত্বলাভ করিতে বসা নিষিদ্ধ। সংসারের কাজ হইলেই সংসার হইতে মুক্তি হইল, তাহার পরে আত্মার অবাধ অনন্ত গতি। তাহা নিশ্চেষ্টতা নহে। সংসারের হিসাবে তাহা জড়ত্বের ন্যায় দৃশ্যমান, কিন্তু চাকা অত্যন্ত ঘুরিলে যেমন তাহাকে দেখা যায় না তেমনি আত্মার অত্যন্ত বেগকে নিশ্চলতা বলিয়া প্ৰতীয়মান হয়। আত্মার সেই বেগকে চতুর্দিকে নানারূপে অপব্যয় না করিয়া সেই শক্তিকে উদবোধিত করিয়া তোলাই আমাদের সমাজের, কাজ ছিল। আমাদের সমাজে প্রবৃত্তিকে খর্ব করিয়া প্ৰত্যহই নিঃস্বাৰ্থ মঙ্গলসাধনের যে ব্যবস্থা আছে তাহা ব্ৰহ্মলাভের সোপান বলিয়াই আমরা তাহা লইয়া গৌরব করি। বাসনাকে ছোটো করিলে আত্মাকেই বড়ো করা হয়, এইজন্যই আমরা বাসনা খর্ব করি—সন্তোষ অনুভব করিকার জন্য নহে। যুরোপ মরিতে রাজি আছে, তবু বাসনাকে ছোটাে করিতে চায় না। আমরাও মরিতে রাজি আছি, তবু আত্মাকে তাহার চরমগতি পরমসম্পদ হইতে বঞ্চিত করিয়া ছোটাে করিতে চাই না। দুৰ্গতির দিনে ইহা আমরা বিস্মৃত হইয়াছি- সেই সমাজ আমাদের এখনো আছে, কিন্তু তাহার ভিতর দিয়া ব্ৰহ্মাভিমুখী মোক্ষাভিমুখী বেগবতী স্রোতোধারা ‘যেনাহং নামৃত স্যাং কিমহং তেন। কুর্যম এই গান করিয়া ধাবিত হইতেছে না মালা ছিল তার ফুলগুলি গেছে রয়েছে। ডোর । সেইজন্য আমাদের এতদিনকার সমাজ আমাদিগকে বল দিতেছে না, গৌরব দিতেছে না, আধ্যাত্মিকতার দিকে আমাদিগকে অগ্রসর করিতেছে না; আমাদিগকে চতুর্দিকে প্রতিহত করিয়া রাখিয়াছে। এই সমাজের মহৎ উদ্দেশ্য যখন আমরা সচেতনভাবে বুঝিব, ইহাকে সম্পূর্ণ সফল করিবার জন্য যখন সচেষ্টভাবে উদ্যত হইব, তখনই মুহুর্তের মধ্যে বৃহৎ হইব, মুক্ত হইব, অমর
পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৫৫
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।
![](http://upload.wikimedia.org/wikisource/bn/thumb/0/0b/%E0%A6%B0%E0%A6%AC%E0%A7%80%E0%A6%A8%E0%A7%8D%E0%A6%A6%E0%A7%8D%E0%A6%B0-%E0%A6%B0%E0%A6%9A%E0%A6%A8%E0%A6%BE%E0%A6%AC%E0%A6%B2%E0%A7%80_%28%E0%A6%A6%E0%A7%8D%E0%A6%AC%E0%A6%BF%E0%A6%A4%E0%A7%80%E0%A6%AF%E0%A6%BC_%E0%A6%96%E0%A6%A3%E0%A7%8D%E0%A6%A1%29_-_%E0%A6%B8%E0%A7%81%E0%A6%B2%E0%A6%AD_%E0%A6%AC%E0%A6%BF%E0%A6%B6%E0%A7%8D%E0%A6%AC%E0%A6%AD%E0%A6%BE%E0%A6%B0%E0%A6%A4%E0%A7%80.pdf/page755-1024px-%E0%A6%B0%E0%A6%AC%E0%A7%80%E0%A6%A8%E0%A7%8D%E0%A6%A6%E0%A7%8D%E0%A6%B0-%E0%A6%B0%E0%A6%9A%E0%A6%A8%E0%A6%BE%E0%A6%AC%E0%A6%B2%E0%A7%80_%28%E0%A6%A6%E0%A7%8D%E0%A6%AC%E0%A6%BF%E0%A6%A4%E0%A7%80%E0%A6%AF%E0%A6%BC_%E0%A6%96%E0%A6%A3%E0%A7%8D%E0%A6%A1%29_-_%E0%A6%B8%E0%A7%81%E0%A6%B2%E0%A6%AD_%E0%A6%AC%E0%A6%BF%E0%A6%B6%E0%A7%8D%E0%A6%AC%E0%A6%AD%E0%A6%BE%E0%A6%B0%E0%A6%A4%E0%A7%80.pdf.jpg)