পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৮৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

9ጓy রবীন্দ্র-রচনাবলী আম-কঁঠালগাছের শিকড় বাহির হইয়া দেখা দিয়াছে যেন তাহাদের নিরুপায় মুষ্টির প্রসারিত কেৰ। শূন্যে একটা-কিছু অন্তিম অবলম্বন আঁকড়াইয়া ধরিবার চেষ্টা করিড়েছে। অঙ্গুলিগুলি দুখিরাম এবং ছিদাম সেদিন জমিদারের কাছারি দূরে কাজ করতে গিয়াছিল। ওপরের চলচ্চিত্র পাকিয়াছে | বর্ষায় চর ভাসিয়া যাইবার পূর্বেই ধান কাটিয়া লইবার জন্য দেশের দরিদ্র লোক মাজেই কবি নিজের খেতে, কেহ বা পাট খাটিতে নিযুক্ত হইয়াছে; কেবল কাছারি হইতে পেয়াদা আসিয়া এই দুই ভাইকে জবরদস্তি করিয়া ধরিয়া লইয়া গেল। কাছারি-ঘরে চাল ভেদ করিয়া স্থানে স্থানে জল পড়িতেছিল। তাহাই সারিয়া দিতে এবং গোটাকতক ঝাপ নির্মাণ করিতে তাহারা সমস্তদিন খাটিয়াছে। বাড়ি আসিতে পায় নাই, কাছারি হইতেই কিঞ্চিৎ জলপান খাইয়াছে। মধ্যে মধ্যে বৃষ্টিতেও ভিজিতে হইয়াছে- উচিতামত পাওনা মজুরি পায় নাই, এবং তাহার পরিবর্তে যে-সকল অন্যায় কটু কথা শুনিতে হইয়াছে, সে তাহাদেৱ পাওনার অনেক অতিরিক্ত । পথের কাদা এবং জল ভাঙিযা সন্ধ্যাবেলায় বাড়ি ফিরিয়া আসিয়া দুই ভাই দেখিল, ছোটাে জা চন্দরা ভূমিতে অঞ্চল পাতিয়া চুপ করিয়া পড়িয়া আছে- আজিকার এই মেঘলা দিনের মতাে সে-ও মধ্যাহ্নে প্রচুর অশ্রুবর্ষণপূর্বক সায়াহ্নের কাছাকাছি ক্ষান্ত দিয়া অত্যন্ত গুমটি করিয়া আছে, আর বড়ো জা রাধা মুখটা মস্ত করিয়া দাওয়ায় বসিয়া ছিল— তাহার দেড় বৎসরের ছােটাে ছেলেটি কঁদিতেছিল, দুই ভাই যখন প্রবেশ করিল, দেখিল উলঙ্গ শিশু প্রাঙ্গণের এক পার্থে চিৎ হইয়া পড়িয়া ঘুমাইয়া আছে। ক্ষুধিত দুখিরাম আর কালবিলম্ব না করিয়া বলিল, “ভাত দে।” বড়োবউ বারুদের বস্তায় স্মৃলিঙ্গের মতো এক মুহূর্তেই তীব্র কণ্ঠস্বর আকাশ-পরিমাণ করিয়া উঠিল, “ভাত কোথায় যে ভাত দিব। তুই কি চাল দিয়া গিয়াছিলি। আমি কি নিজে রোজগার করিয়া আনিব।” সারাদিনের শ্রান্তি ও লাঞ্ছনার পর অন্নহীন নিরানন্দ অন্ধকার ঘরে প্রজ্বলিত ক্ষুধানলে গৃহিণীর রুক্ষবচন বিশেষত শেষ কথাটার গোপন কুৎসিত শ্লেষ দুখিরামের হঠাৎ কেমন একেবারেই অসহ্য হইয়া উঠিল। ক্রুদ্ধ ব্যান্ত্রের ন্যায় গভীর গর্জনে বলিয়া উঠিল, “কী বললি।” বলিয়া মুহুর্তের মধ্যে দা লইয়া কিছু না ভাবিয়া একেবারে স্ত্রীর মাথায় বসাইয়া দিল। রাধা তাহার ছােটাে জায়ের কোলের কাছে পড়িয়া গেল এবং মৃত্যু श्शङ भूङ्र्ड दिलश् शंश्ल ना । চন্দরা রক্তসিক্ত বস্ত্রে “কী হল গে” বলিয়া চীৎকার করিয়া উঠিল। ছিদাম তাহার মুখ চাপিয়া ধরিল। দুখিরাম দা ফেলিয়া মুখে হাত দিয়া হতবুদ্ধির মতো ভূমিতে বসিয়া পড়িল। ছেলেটা জাগিয়া উঠিয়া ভয়ে চীৎকার করিয়া কঁদিতে লাগিল । বাহিরে তখন পরিপূর্ণ শান্তি । রােখালাবালক গোরু লইয়া গ্রামে ফিরিয়া আসিতেছে। পরপরের চরে যাহারা নূতনপক্ক ধান কাটিতে গিয়াছিল, তাহারা পাঁচ-সাতজনে এক-একটি ছােটাে নীেকায় এপারে ফিরিয়া পরিশ্রমের পুরস্কার দুই-চারি আঁটি ধান মাথায় লইয়া প্রায় সকলেই নিজ নিজ ঘরে আসিয়া পৌঁছিয়াছে। চক্রবর্তদের বাড়ির রামলোচন খুড়ো গ্রামের ডাকঘরে চিঠি দিয়া ঘরে ফিরিয়া নিশ্চিন্তমনে চুপচাপ তামাক খাইতেছিলেন । হঠাৎ মনে পড়িল, তাহার কোর্য্যা প্ৰজা দুখির অনেক টাকা খাজনা বাকি ; আজ কিয়দংশ শোধ করিবে প্রতিশ্রুত হইয়াছিল। এতক্ষণে তাহারা বাড়ি ফিরিয়াছে স্থির করিয়া চাদরটা কঁধে ফেলিয়া ছাতা লইয়া বাহির হইলেন । কুরিদের বাড়িতে ঢুকিয়া তাহার গা ছমছম করিয়া উঠিল। দেখিলেন ঘরে প্রদীপ জ্বালা হয় নাই। অন্ধকার দাওয়ায় দুই-চারিটা অন্ধকার মূর্তি অস্পষ্ট দেখা যাইতেছে। রহিয়া রহিয়া দাওয়ার এক কোণ হইতে একটা অস্ফুট রোিদন উচ্ছসিত হইয়া উঠিতেছে— এবং ছেলেটা যত মা মা বলিয়া কঁাদিয়া উঠিতে চেষ্টা করিতেছে ছিদাম তাহার মুখ চাপিয়া ধরিতেছে। দুখি এতক্ষণ প্রস্তরমূর্তির মতো নিশ্চল হইয়া বসিয়া ছিল, তাহার নাম ধরিয়া ডাকিবামাত্র একেবারে অবোধ বালকের মতো উচ্ছসিত হইয়া কঁাদিয়া উঠিল । ቴ ছিদাম তাড়াতাড়ি দাওয়া হইতে অঙ্গনে নামিয়া চক্রবর্তীর নিকট আসিল । চক্রবর্তী জিজ্ঞাসা করিলেন,