পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৮৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

r রবীন্দ্র-রচনাবলী বিজ্ঞান বলে, তুমি অত্যন্ত বেশি দূরে আছ বলেই দেখছ, তারাগুলো স্থির। কিন্তু সেটা সত্য নয়। আমি বলি, তুমি অত্যন্ত বেশি কাছে উকি মারছ বলেই বলছি। ওরা চলছে। কিন্তু সেটা সত্য নয়। বিজ্ঞান চোখ পাকিয়ে বলে, সে কেমন কথা ? আমিও চোখ পাকিয়ে জবাব দিই, কাছের পক্ষ নিয়ে তুমি যদি দূরকে গাল দিতে পাের তবে দূরের পক্ষ নিয়ে আমিই বা কাছকে গাল দেব না কেন ? বিজ্ঞান বলে, যখন দুই পক্ষ একেবারে উলটাে কথা বলে তখন ওদের মধ্যে এক পক্ষকেই মানতে হয়। আমি বলি, তুমি তা তো মান না। পৃথিবীকে গোলাকার বলবার বেলায় তুমি অনায়াসে দূরের দােহাই পাড়। তখন বল, কাছে আছি বলেই পৃথিবীটাকে সমতল বলে ভ্রম হয়। তখন তোমার তর্ক এই যে, কাছে থেকে কেবল অংশকে দেখা যায়, দূরে না দাঁড়ালে সমগ্রকে দেখা যায় না। তোমার এ কথাটায় সায় দিতে রাজি আছি। এইজন্যই তো আপনার সম্বন্ধে মানুষের মিথ্যা অহংকার। কেননা আপনি অত্যন্ত কাছে। শাস্ত্ৰে তাই বলে, আপনাকে যে লোক অন্যের মধ্যে দেখে সেই সত্য দেখে- অর্থাৎ আপনার থেকে দূরে না গেলে আপনার গোলাকার বিশ্বরূপ দেখা যায় না । দূরকে যদি এতটা খাতিরই কর তবে কোন মুখে বলবে, তারাগুলো ছুটােছুটি করে মরছে ? মধ্যাহ্নসূর্যক চোখে দেখতে গেলে কালো কাচের মধ্য দিয়ে দেখতে হয়। বিশ্বলোকের জ্যোতির্ময় দুৰ্দর্শরূপকে আমরা সমগ্রভাবে দেখব বলেই পৃথিবী এই কালে রাত্রিটাকে আমাদের চােখের উপর ধরেছেন। তার মধ্যে দিয়ে কী দেখি ? সমস্ত শান্ত, নীরব। এত শান্ত, এত নীরব যে আমাদের হাউই, তুবড়ি, তারাবাজিগুলো তাদের মুখের সামনে উপহাস করে আসতে ভয় করে না। আমরা যখন সমস্ত তারাকে পরস্পরের সঙ্গে সম্বন্ধযোগে মিলিয়ে দেখছি তখন দেখছি তারা অবিচলিত স্থির। তখন তারা যেন গজমুক্তার সাতনলীহার। জ্যোতির্বিদ্যা যখন এই সম্বন্ধসূত্রকে বিচ্ছিন্ন করে কোনো তারাকে দেখে তখন দেখতে পায় সে চলছে- তখন হার-ছেড়া মুক্তা টলটল করে গড়িয়ে বেড়ায় { এখন মুশকিল। এই বিশ্বাস করি কাকে ? বিশ্বতারা অন্ধকার সাক্ষ্যমঞ্চের উপর দাড়িয়ে যে সাক্ষ্য দিচ্ছে তার ভাষা নিতান্ত সরল- একবার কেবল চােখ মেলে তার দিকে তাকালেই হয়, আর কিছুই করতে হয়। না। আবার যখন দু-একটা তারা তাদের বিশ্বাসন থেকে নীচে নেমে এসে গণিতশাস্ত্রের গুহার মধ্যে ঢুকে কানে কানেকী সব বলে যায় তখন দেখি সে আবার আর-এর কথা। যারা স্বাদলের সম্বন্ধ ছেড়ে এসে পুলিস ম্যাজিষ্ট্রেটের প্রাইভেট কামরায় ঢুকে সমস্ত দলের একজোট সংক্ষ্যের বিরুদ্ধে গোপন সংবাদ ফাস করে দেবার ভান করে সেই সমস্ত অ্যাণুভারদেই যে পরম সত্যবাদী বলে গণ্য করতেই হবে এমন কথা নেই। কিন্তু এই সমস্ত অ্যাণুভাররা বিস্তারিত খবর দিয়ে থাকে। বিস্তারিত খবরের জোর বড়ো বেশি। সমস্ত পৃথিবী বলছে আমি গােলাকার, কিন্তু আমার পায়ের তলার মাটি বলছে আমি সমতল। পায়ের তলার মাটির জোর বেশি, কেননা সে যেটুকু বলে সে একেবারে তন্ন তন্ন করে বলে। পায়ের তলার মাটির কাছ থেকে পাই তথ্য, অর্থাৎ কেবল তথাকার খবর, বিশ্বপূথিবীর কাছ থেকে পাই সত্য, অর্থাৎ সমস্তটার খবর। আমার কথাটা এই যে কোনোটাকে উড়িয়ে দেওয়া চলে না। আমাদের যে দুইই চাই। তথ্য না হলেও আমাদের কাজকর্মবন্ধ, সত্য না হলেও আমাদের পরিত্রাণ নেই। নিকট এবং দূর, এই দুই নিয়েই আমাদের যত কিছু কারবার। এমন অবস্থায় এদের কারও প্রতি যদি মিথ্যার কলঙ্ক আরোপ করি তবে সেটা আমাদের নিজের গায়েই লাগে । অতএব যদি বলা যায়, আমাদের দূরের ক্ষেত্রে তারা স্থির আছে, আর আমার নিকটের ক্ষেত্রে তারা দৌড়োচ্ছে তাতে দোষ কী? নিকটকে বাদ দিয়ে দূর, এবং দূরকে বাদ দিয়ে নিকট যে একটা ভয়ংকর কবন্ধ। দূর এবং নিকট এরা দুইজনে দুই বিভিন্ন তথ্যের মালিক কিন্তু এরা দুজনেই কি এক সত্যের অধীন নয় ? তাদেজাঁতিতরৈজািততদূরে তাত্তিকে। তিনি চলেন এবং তিনি চলেন না, তিনি দূরে এবং তিনি নিকটে এ দুইই একসঙ্গে সত্য। অংশকেও মানি, সমস্তকেও মানি ; কিন্তু সমগ্রবিহীন অংশ ঘোর অন্ধকার এবং অংশবিহীন সমগ্র আরো ঘোর অন্ধকার।