পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬০৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

পরিচয় । ©ክrእ) উত্তীর্ণ করিয়া লইল । অনার্যের চিত্তে যাহা কেবল রসমাদকতারূপে ছিল আৰ্য তাঁহাকে সত্যের মধ্যে নিত্যপ্রতিষ্ঠ করিয়া দেখিল— তাহা কেবল বিশেষ জাতির বিশেষ একটি পুরাণকথারূপে রহিল না, তাহা সমস্ত মানবের একটি চিরন্তন আধ্যাত্মিক সত্যের রূপকারাপে প্রকাশ পাইল। আৰ্য এবং দ্রাবিড়ের সম্মিলনে রসের, একের সহিত বিচিত্রের অন্তরতম সংযোগ ঘটিয়াছে। আৰ্যসমাজের মূলে পিতৃশাসনতন্ত্র, অনাৰ্যসমাজের মূলে মাতৃ শাসনতন্ত্র। এইজন্য বেদে স্ত্রীদেবতার প্রাধান্য নাই। আৰ্যসমাজে অনার্যপ্রভাবের সঙ্গে এই গ্ৰীদেবতাদের প্রাদুর্ভাব ঘটিতে লাগিল। তাহা লইয়াও যে সমাজে বিস্তর বিরোধ ঘটিয়াছে প্রকৃত সাহিত্যে তাহার নিদর্শন দেখিতে পাওয়া যায়। এই দেবীতম্বের মধ্যেও এক দিকে হৈমবতী উমার সুশোভনা আর্যমূর্তি, অন্য দিকে করালী কালিকার কপালমালিনী বিবসনা ffð | কিন্তু সমস্ত অনার্য অনৈক্যকে তাহার সমস্ত কল্পনাকাহিনী আচার ও পূজাপদ্ধতি লইয়া আর্যভাবের ঐক্যসূত্রে আদ্যোপােন্ত মিলিত করিয়া তোলা কোনোমতেই সম্ভবপর হয় না- তাহার সমস্তটাকেই রক্ষা করিতে গেলে তাহার মধ্যে শত সহস্ৰ অসংগতি থাকিয়া যায়। এই সমস্ত অসংগতির কোনোপ্রকার সমন্বয় হয় না- কেবল কালক্রমে তাহা অভ্যস্ত হইয়া যায় মাত্র। এই অভ্যাসের মধ্যে অসংগতিগুলি একত্র থাকে, তাহাদের মিলিত করিবার প্রয়োজনবোধও চলিয়া যায়। তখন ধীরে ধীরে এই নীতিই সমাজে প্রবল হইয়া উঠে যে, যাহার যেরূপ শক্তি ও প্রবৃত্তি সে সেইরূপ পূজা আচার লইয়াই থাক। ইহা একপ্রকার হাল ছাড়িয়া দেওয়া নীতি । যখন বিরুদ্ধগুলিকে পাশে রাখিতেই হইবে অথচ কোনোমতেই মিলাইতে পারা যাইবে না। তখন এই কথা ছাড়া অন্য কথা হইতেই পারে না। এইরূপে বৌদ্ধযুগের প্রলয়াবসানে বিপর্যন্ত সমাজের নূতন পুরাতন সমস্ত বিচ্ছিন্ন পদাৰ্থ লইয়া ব্ৰাহ্মণ যেমন করিয়া পারে সেগুলিকে সাজাইয়া শৃঙ্খলাবদ্ধ করিতে বসিল। এমন অবস্থায় স্বভাবতই শৃঙ্খল অত্যন্ত কঠিন হইয়া উঠে । যাহারা স্বতই স্বতন্ত্র, যাহারা নানা জাতির নানা কালের সামগ্ৰী, তাহাদিগকে এক করিয়া বাঁধিতে গেলে বাধন অত্যন্ত আঁটি করিয়া রাখিতে হয়- তাহারা জীবনধর্মের নিয়ম-অনুসারে আপনার যোগ আপনিই সাধন করে না । ভারতবর্ষে ইতিহাসের আরম্ভযুগে যখন আর্য-অনার্যে যুদ্ধ চলিতেছিল তখন দুই পক্ষের মধ্যে একটা প্রবল বিরোধ ছিল। এইপ্ৰকার বিরোধের মধ্যেও এক প্রকারের সমকক্ষতা থাকে। মানুষ যাহার সঙ্গে লড়াই করে তাহাকে তীব্রভাবে দ্বেষ করিতে পারে। কিন্তু তাহাকে মনের সঙ্গে অবজ্ঞা করিতে পারে না । এইজন্য ক্ষত্রিয়দের বিবাহের ফর্দ ধরিলেই তাহা বুঝা যাইবে। কিন্তু ইতিহাসের পরবর্তী যুগে যখন আর-এক দিন অনাৰ্যবিরোধ তীব্ৰ হইয়া উঠিয়ছিল অনার্যেরা তখন আর বাহিরো নাই তাহারা একেবারে ঘরে ঢুকিয়া পড়িয়ছে। সুতরাং তখন যুদ্ধ করিবার দিন আর নাই। এইজন্য সেই অবস্থায় বিদ্বেষ একান্ত একটা ঘূণার আকার ধরিয়াছিল। এই ঘূণাই তখন অস্ত্ৰ। ঘূণার দ্বারা মানুষকে কেবল যে দূরে ঠেকাইয়া রাখা যায় তাহা নহে, যাহাকে সকল প্রকারে ঘূণা করা যায় তাহারও মন আপনি খাটাে হইয়া আসে ; সেও আপনার হীনতার সংকোচে সমাজের মধ্যে কুষ্ঠিত হইয়া থাকে ; যেখানে সে থাকে। সেখানে সে কোনোরাপ অধিকার দাবি করে না । এইরূপ যখন সমাজের এক ভাগ আপনাকে নিকৃষ্ট বলিয়াই স্বীকার করিয়া লয় এবং আর-এক ভাগ আপনার আধিপত্যে কোনাে বাধাই পায় না- তখন নীচে সে যতই অবনত হয় উপরে যে থাকে সেও ততই নামিয়া পড়িতে থাকে। ভারতবর্ষে আত্মপ্রসারণের দিনে যে অনার্যবিদ্বেষ ছিল এবং আত্মসংকোচনের দিনে যে অনাৰ্যবিদ্বেষ জাগিল উহার মধ্যে অত্যন্ত প্রভেদ। প্রথম বিদ্বেষের সমতলটানে মনুষ্যত্ব খাড়া থাকে,দ্বিতীয় বিদ্বেষের নীচের টানে মনুষ্যত্ব নামিয়া যায়। যাহাকে মারি সে যখন ফিরিয়া মারে তখন মানুষের মঙ্গল, যাহাকে মারি সে যখন নীরবে সে মার মাথা পাতিয়া লয় তখন বড়ো দুৰ্গতি। বেদে অনার্যদের প্রতি যে বিদ্বেষপ্রকাশ আছে তাহার মধ্যে পৌরুষ দেখিতে । পাই, মনুসংহিতায় শূদ্রের প্রতি যে একান্ত অন্যায় ও নিষ্ঠুর অবজ্ঞা দেখা যায় তাহার মধ্যে কাপুরুষতারই 8||9by