পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৫০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

VOS রবীন্দ্ররচনাবলী তার উপরে কালো রেখাটি বিচিত্রনৃত্যে ছন্দে ছন্দে ছবি হইয়া উঠিতেছে। শুত্র ও নিন্তব্ধ অসীম ছবির ছাপ মারিতেছে। কালিরেখার সেই নৃত্যের ছন্দটি লইয়া চিত্রকলার রূপভেদঃ প্রমাণানি। নৃত্যের বিচিত্র বিক্ষেপগুলি রূপের ভেদ, আর তার ছন্দের তালটিই প্রমাণ। আলো আর কালো অর্থাৎ আলো আর না-আলোর দ্বন্দ্ব খুবই একান্ত। রঙগুলি তারই মাঝখানে মধ্যস্তৃতা করে। ইহারা যেন বীণার আলাপের মীড়- এই মীড়ের দ্বারা সুরা যেন সুরের অতীতকে পর্যায়ে পর্যয়ে ইশারায় দেখাইয়া দেয়- ভঙ্গিতে ভঙ্গিতে সুর আপনাকে অতিক্ৰম করিয়া চলে। তেমনি রঙের ভঙ্গি দিয়া রেখা আপনাকে অতিক্রম করে ; রেখা যেন অরেখার দিকে আপনি ইশারাচালাইতে থাকে। রেখা জিনিসটা সুনির্দিষ্ট-আর রঙ জিনিসটা নির্দিষ্ট-অনির্দিষ্ট্রর সেতু, তাহা সাদা কালের মাঝখানকার নানা টানের মীড়। সীমার বঁাধনে বাধা কালো রেখার তারটাকে সাদা যেন খুব তীব্ৰ করিয়া আপনার দিকে টানিতেছে, কালে তাই কড়ি হইতে অতি-কোমলের ভিতর দিয়া রঙে রঙে অসীমকে স্পর্শ করিয়া চলিয়াছে। তাই বলিতেছি। রঙ জিনিসটা রেখা এবং অরেখার মাঝখানের সমস্ত ভঙ্গি। রেখা ও অরেখার মিলনে যে ছবির সৃষ্টি সেই ছবিতে এই মধ্যন্থের প্রয়ােজন। অরেখ সাদার বুকের উপর যেখানে রেখা-কালির নৃত্য সেখানে এই রঙগুলি যোগিনী। শাস্ত্রে ইহাদের নাম সকলের শেষে থাকিলেও ইহাদের কােজ নেহাত কম নয়। পূর্বেই বলিয়াছি সাদার উপর শুধু রেখার ছবি হয়, কিন্তু সাদার উপর শুধু রঙে ছবি হয় না। তার কারণ রঙ জিনিসটা মধ্যস্থা- দুই পক্ষের মাঝখানে ছাড়া কোনো স্বতন্ত্র জায়গায় তার অর্থই থাকে না। এই গেল বণিকভঙ্গ । এই ছবির ছয় অঙ্গের সঙ্গে কবিতার কিরূপ মিল আছে তাহা দেখাইলেই কথাটা বোঝা হয়তো সহজ श्व | ছবির স্কুল উপাদান যেমন রেখা তেমনি কবিতার স্থূল উপাদান হইল বাণী। সৈন্যদলের চালের মতো সেই বাণীর চালে একটা ওজন একটা প্রমাণ আছে- তাহাঁই ছন্দ । এই বাণী ও বাণীর প্রমাণ বাহিরের অঙ্গ, ভিতরের অঙ্গ ভাব ও মাধুর্য। " এই বাহিরের সঙ্গে ভিতরকে মিলাইতে হইবে। বাহিরের কথাগুলি ভিতরের ভাবের সদৃশ হওয়া চাই ; তাহা হইলেই সমস্তটায় মিলিয়া কবির কাব্য কবির কল্পনার সাদৃশ্য লাভ করবে। বহিঃসাদৃশ্য, অর্থাৎ রূপের সঙ্গে রাপের সাদৃশ্য, অর্থাৎ যেটাকে দেখা যায় সেইটাকে ঠিকঠাক করিয়া বর্ণনা করা কবিতার প্রধান জিনিস নহে। তাহা কবিতায় লক্ষ্য নহে উপলক্ষ মাত্র। এইজন্য বর্ণনামাত্রই যে-কবিতার পরিণাম, রসিকেরা তাহাকে উচুদরের কবিতা বলিয়া গণ্য করেন না। বাহিরকে ভিতরের করিয়া দেখা ও ভিতরকে বাহিরের রূপে ব্যক্ত করা ইহাই কবিতা এবং সমস্ত আর্টেরই লক্ষ্য। সৃষ্টিকর্তা একেবারেই আপন পরিপূর্ণত হইতে সৃষ্টি করিতেছেন তীর আর-কোনো উপসর্গ নাই। কিন্তু বাহিরের সৃষ্টি মানুষের ভিতরের তারেঘ দিয়া যখন একটা মানস-পদার্থক জন্ম দেয়, যখন একটারসের সুর বাজায় তখনই সে আর থাকিতে পারে না, বাহিরে সৃষ্ট হইবার কামনা করে। ইহাই মানুষের সকল সৃষ্টির গোড়ার কথা। এইজনাই মানুষের সৃষ্টিতে ভিতর বাহিরের ঘাত-প্রতিঘাত। এইজন্য মানুষের সৃষ্টিতে বাহিরের জগতের আধিপত্য আছে। কিন্তু একাধিপত্য যদি থাকে, যদি প্রকৃতির ধাম-ধরা হওয়াই কোনো আর্টিস্টের কাজ হয় তবে তার দ্বারা সৃষ্টিই হয় না। শরীর বাহিরের খাবার খায় বটে। কিন্তু তাহাকে অবিকৃত বমন করিবে বলিয়া নয়। নিজের মধ্যে তাহার বিকার জন্মাইয়া তাহাকে নিজের করিয়া লইবে বলিয়া। তখন সেই খাদ্য এক দিকে রসরািক্তরূপে বাহ্য আকার,আর-একদিকে শক্তিস্বাস্থ্য সৌন্দর্যরূপে আন্তর আকার ধারণ করে। ইহাই শরীরের সৃষ্টিকার্য। মনের সৃষ্টিকাৰ্যও এমনিতরো। তাহা বাহিরের বিশ্বকে বিকারের দ্বারা যখন আপনার করিয়া লয় তখন সেই মানস-পদার্থটা এক দিকে বাক্য রেখা সুর প্রভৃতি বাহা আকার, অন্যদিকে সৌন্দর্য শক্তি প্রভৃতি আন্তর আকার ধারণ করে। ইহাই মনের সৃষ্টি- যাহা দেখিলাম অবিকল তাঁহাই দেখানো সৃষ্টি নহে। তার পরে ছবিতে যেমন বর্ণিকাভঙ্গং কবিতায় তেমনি ব্যঞ্জনা (suggestiveness)। এই ব্যঞ্জনার দ্বারা