পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৬০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Es8 R রবীন্দ্র-রচনাবলী জমায়। বুদ্ধি-বিবেচনা আসিয়া সেটা দাবি করে ; সেইজন্য ঘোমটা টানিয়া হৃদয়কে সেখান হইতে এক সরিয়া দাড়াইতে হয়। তাই দেখা যায় তাম্রবর্ণ পাকা আমেরি ভরে গাছের ডালগুলি নত হইয়া পড়িং বিরাহিণীর রসনায় যে রসের উত্তেজনা উপস্থিত হয় সেটা গীতিকাব্যের বিষয় নহে। সেটা অত্যন্ত বাস্ত সেটার মধ্যে যে প্রয়োজন আছে তাহা টাকা-আনা-পাইয়ের মধ্যে বাধা। যাইতে পারে। । বর্ষা-ঋতু নিম্প্রয়োজনের ঋতু। অর্থাৎ তাহার সংগীতে তাহার সমারোহে, তাহার অন্ধকারে তাহা দীপ্তিতে, তাহার চাঞ্চল্যে তাহার গাষ্ঠীর্ষে তাহার সমস্ত প্রয়োজন কোথায় ঢাকা পড়িয়া গেছে। এই ধা ছুটির ঋতু। তাই ভারতবর্ষেবর্ধায় ছিল ছুটি- কেননা ভারতবর্ষে প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের একটা বোঝাপড় ছিল। ঋতুগুলি তাহার দ্বারের বাহিরে দাঁড়াইয়া দর্শন না পাইয়া ফিরিত না। তাহার হৃদয়ের মধ্যে ঋতু অভ্যর্থনা চলিত । ভারতবর্ষের প্রত্যেক ঋতুরই একটানা-একটা উৎসব আছে। কিন্তু কোন ঋতু যে নিতান্ত বিনা-কার তাহার হৃদয় অধিকার করিয়াছে তাহা যদি দেখিতে চাও তবে সংগীতের মধ্যে সন্ধান করো। কেন, সংগীতেই হৃদয়ের ভিতরকার কথাটা ফাস হইয়া পড়ে। বলিতে গেলে ঋতুর রাগরাগিণী কেবল বর্ষার আছে আর বসন্তের। সংগীত-শান্ত্রের মধ্যে সকল ঋতুর জন্য কিছু কিছু সুরের বরাদ্দ থাকা সম্ভব- কিন্তু সেটা কেবল শাস্ত্রগত। ব্যবহারে দেখিতে পাই বসন্তে জন্য আছে বসন্ত আর বাহার- আর বর্ষার জন্য মেঘ, মল্লার, দেশ, এবং আরো বিস্তর। সংগীতের পাড়া ভোট লইলে বর্ষারই হয়। জিত । শরতে হেমন্তে ভর-মাঠ ভরা-নদীতে মন নাচিয় ওঠে ; তখন উৎসবেরও অন্ত নাই, কিন্তু রাগিণীতে তাহার প্রকাশ রহিল না কেন ? তাহার প্রধান কারণ, ঐ ঋতুতে বাস্তব ব্যস্ত হইয়া আসিয়া মাঠঘাট জুড়ি বসে । বাস্তবের সভায় সংগীত মুজরা দিতে আসে না- যেখানে অখণ্ড অবকাশ সেখানেই সে সেলা করিয়া বসিয়া যায় । যাহারা বস্তুর কারবার করিয়া থাকে তাহারা যেটাকে অবস্তু ও শূন্য বলিয়া মনে করে সেটা কম জিনি নয়। লোকালয়ের হাটে ভূমি বিক্রি হয়, আকাশ বিক্রি হয় না । কিন্তু পৃথিবীর বস্তুপিণ্ডকে ঘেরিয়া ( বায়ুমণ্ডল আছে, জ্যোতির্লোক হইতে আলোকের দূত সেই পথ দিয়াই আনাগােনা করে। পৃথিবীর সম লাবণ্য ঐ বায়ুমণ্ডলে। ঐখানেই তাহার জীবন। ভূমি ধ্রুব, তাহা ভারী, তাহার একটা হিসাব পাওয়া যায় কিন্তু বায়ুমণ্ডলে যে কত পাগলামি তাহা বিজ্ঞ লোকের অগােচর নাই। তাহার মেজাজ কে বােঝে ? পৃথিবী সমস্ত প্রয়োজন ধূলির উপরে, কিন্তু পৃথিবীর সমস্ত সংগীত ঐ শূন্যে- যেখানে তাহার অপরিচ্ছি অবকাশ । মানুষের চিত্তের চারিদিকেও একটি বিশাল অবকাশের বায়ুমণ্ডল আছে। সেইখনেই তাহার নানারঙ খেয়াল ভাসিতেছে ; সেইখানেই অনন্ত তাহার হাতে আলোকের রাখী বধিতে আসে ; সেইখানেই ঝড়বৃf সেইখানেই উনপঞ্চাশ বায়ুর উন্মত্ততা, সেখানকার কোনো হিসাব পাওয়া যায় না। মানুষের ( অতিচৈতন্যলোকে অভাবনীয়ের লীলা চলিতেছে সেখানে যে-সব অকেজো লোক আনাগোনা রাখি চায়- তাহারা মাটিকে মান্য করে বটে। কিন্তু বিপুল অবকাশের মধ্যেই তাহদের বিহার। সেখানকার ভাষা সংগীত । এই সংগীতে বান্তবলোকে বিশেষ কী কাজ হয় জানি না- কিন্তু ইহারই কম্পমান পক্ষে আঘাত-বেগে অতিচৈতন্যলোকের সিংহদ্বার খুলিয়া যায়। মানুষের ভাষার দিকে একবার তাকাও ৷ ঐ ভাষাতে মানুষের প্রকাশ ; সেইজন্যে উহার মধ্যে এ রহস্য। শব্দের বস্তুটা হইতেছে তাহার অর্থ। মানুষ যদি কেবলমাত্র হইত বাস্তব, তবে তাহার ভাষার শা নিছক অর্থ ছাড়া আর কিছুই থাকিত না। তবে তাহার শব্দ কেবলমাত্র খবর দিত- সুর দিত না। কি বিস্তর শব্দ আছে যাহার অর্থািপণ্ডের চারিদিকে আকাশের অবকাশ আছে, একটা বায়ুমণ্ডল আছে। তাহা যেটুকু জানায় তাহারা তাহার চেয়ে অনেক বেশি- তাহদের ইশারা তাহদের বাণীর চেয়ে বড়ো। ইহাদে পরিচয় তদ্ধিত প্রত্যয়ে নহে, চিত্তপ্রত্যয়ে। এই সমস্ত অবকাশওয়ালা কথা লইয়া অবকাশবিহারী কবিদে কারবার। এই অবকাশের বায়ুমণ্ডলেই নানা রঙিন আলোর রঙ ফলাইবার সুযোগ- এই ফাকটাতে