পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭১২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

88 রবীন্দ্র-রচনাবলী এই পরিচ্ছেদে উল্লিখিত উপনয়ন অনুষ্ঠানের বিস্তৃত বিবরণ ও প্রধান আচাৰ্য মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের উপদেশ ১৭৯৪ শকের চৈত্রের তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় ‘ব্রাহ্মধর্মের অনুষ্ঠান । উপনয়ন । সমাবর্তন।” এই নামে (পৃ ২০৩-২০৬) মুদ্রিত হইয়াছিল। সেখানে ‘তিন বাঁটুর মধ্যে কেবল অগ্রজ সোমেন্দ্রনাথের নাম উল্লিখিত হইয়াছে। 'হিমালয়যাত্রা পরিচ্ছেদে বােলপুর-ভ্রমণের যে বৃত্তান্ত আছে জীবনস্মৃতি লিখিবার বহু পরে “আশ্রম-বিদ্যালয়ের সূচনা’-নামক প্রবন্ধে (প্রবাসী, আশ্বিন ১৩৪০) প্রসঙ্গত রবীন্দ্রনাথ তাহার এক বিশদ ও গভীরতর বর্ণনা দিয়াছেন : “আমার বয়স যখন অল্প পিতৃদেবের সঙ্গে ভ্ৰমণে বের হয়েছিলেম। ঘর ছেড়ে সেই আমার প্ৰথম বাহিরে যাত্রা । ইটকাঠের অরণ্য থেকে অবারিত আকাশের মধ্যে বৃহৎ মুক্তি এই প্রথম আমি ভোগ করেছি। প্রথম বললে সম্পূর্ণ ঠিক বলা হয় না। এর পূর্বে কলকাতায় একবার যখন ডেঙ্গুজুর সংক্রামক হয়ে উঠেছিল তখন আমার গুরুজনদের সঙ্গে আশ্রয় নিয়েছিলেম গঙ্গার ধারে লালাবাবুদের বাগানে । বসুন্ধরার উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে সুদূরব্যাপ্ত আস্তরণের একটি প্রান্তে সেদিন আমার বসবার আসন জুটেছিল। সমস্ত দিন বিরাটের মধ্যে মনকে ছাড়া দিয়ে আমার বিস্ময়ের এবং আনন্দের ক্লান্তি ছিল না । কিন্তু তখনো আমি আমাদের পূর্ব নিয়মে ছিলেম বন্দী, অবাধে বেড়ানো ছিল নিষিদ্ধ। অর্থাৎ কলকাতায় ছিলেম ঢাকা-খাচার পাখি- কেবল চলার স্বাধীনতা নয়, চোখের স্বাধীনতাও ছিল সংকীর্ণ- এখানে রইলুম দাড়ের পাখি, আকাশ খোলা চারি দিকে কিন্তু পায়ে শিকল । শান্তিনিকেতনে এসেই আমার জীবনে প্রথম সম্পূর্ণ ছাড়া পেয়েছি বিশ্বপ্রকৃতির মধ্যে। উপনয়নের পরেই আমি এখানে এসেছি। উপনয়ন অনুষ্ঠানে ভুর্ভুবঃ স্বর্লোকের মধ্যে চেতনাকে পরিব্যাপ্ত করবার যে দীক্ষা পেয়েছিলেম পিতৃদেবের কাছ থেকেএখানে বিশ্বদেবতার কাছ থেকে পেয়েছিলেম সেই দীক্ষাই । আমার জীবন নিতান্তই অসম্পূর্ণ থাকত প্ৰথম বয়সে এই সুযোগ যদি আমার না ঘটত। পিতৃদেব কোনো নিষেধ বা শাসন দিয়ে আমাকে বেষ্টন করেন নি । সকালবেলায় অল্প কিছুক্ষণ র্তার কাছে ইংরেজি ও সংস্কৃত পড়তেম, তার পরে আমার অবাধ ছুটি । বোলপুর শহর তখন স্ফীত হয়ে ওঠে নি। চালের কলের ধোয়া আকাশকে কলুষিত আর তার দুৰ্গন্ধ সমল করে নি মলয় বাতাসকে । মাঠের মাঝখান দিয়ে যে লাল মাটির পথ চলে গেছে তাতে লোকচলাচল ছিল অল্পই। বাধের জল ছিল পরিপূর্ণ প্রসারিত, চার দিক থেকে পলি-পড়া চাষের জমি তাকে কোণঠেসা করে আনে নি। তার পশ্চিমের উচু পাড়ির উপর অক্ষুন্ন ছিল ঘন তালগাছের শ্রেণী । যাকে আমরা খোয়াই বলি, অর্থাৎ কঁাকুরে জমির মধ্যে দিয়ে বর্ষার জলধারায় আঁকাবঁকা উচুনিচু খোদাই পথ, সে ছিল নানা জাতের নানা আকৃতির পাথরে পরিকীর্ণ ; কোনােটাতে শির-কাটা পাতার ছাপ, কোনােটা লম্বা-আঁশ-ওয়ালা কাঠের টুকরোর মতো, কোনোটা স্ফটিকের-দানা-সাজানো, কোনোটা অগ্নিগলিত মসৃণ ।-- আমিও সমস্ত দুপুরবেলা খোয়াইয়ে প্রবেশ করে নানা রকম পাথর সংগ্রহ করেছি, ধন-উপার্জনের লোভে নয়, পাথর-উপার্জন করতেই। মাঠের জল চুইয়ে সেই খোয়াইয়ের এক জায়গায় উপরের ডাঙা থেকে ছোটো ঝর্না ঝরে পড়ত । সেখানে জন্মেছিল একটি ছোটো জলাশয়, তার সাদাটে ঘোলাজল, আমার পক্ষে ডুব দিয়ে স্নান করবার মতো যথেষ্ট গভীর। সেই ডোবাটা উপচিয়ে ক্ষীণ স্বচ্ছ জলের স্রোত ঝির ঝির করে বয়ে যেত নানা শাখা-প্ৰশাখায়, ছোটাে ছোটাে মাছ সেই স্রোতে উজান মুখে সীতার কাটত । আমি জলের ধার বেয়ে বেয়ে আবিষ্কার করতে বের তুম সেই শিশুভূবিভাগের নতুন নতুন বালখিল্য গিরিনদী। মাঝে মাঝে পাওয়া যেত পাড়ির গায়ে গহবর। তার মধ্যে নিজেকে প্রচ্ছন্ন করে অচেনা জিওগ্র্যাফির মধ্যে ভ্ৰমণকারীর গীেরব অনুভব করতুম। খোয়াইয়ের স্থানে স্থানে যেখানে মাটি জমা সেখানে বেঁটে বেঁটে বুনোজাম বুনােখেজুর— কোথাও বা ঘন কাশ লম্বা হয়ে উঠেছে। উপরে দূর মাঠে গােরু চরছে।