পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৪৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

a Str ▪ኔ রবীন্দ্র-রচনাবলী আশ্চর্যের বিষয় এই যে, তত্ত্বকৌমুদী-সম্পাদক মহাশয় আমার উক্তি স্বীকার করিয়াও আমার প্রবন্ধের প্রতি বিরুদ্ধভােব ধারণা করিয়াছেন । তিনি একজায়গায় স্পষ্টই বলিয়াছেন যে, ‘ব্রাহ্মধর্ম কেবল যে হিন্দুদের মধ্যেই আবদ্ধ থাকিবে তাহা নহে, ব্ৰাহ্মগণ কেবল যে হিন্দুবংশোদ্ভব ব্যক্তিগণের মধ্যেই অবস্থিত থাকিবেন তাহা নহে, সর্বদেশের লোক এই উদার ধর্ম গ্ৰহণ করিতে পরিবেন।**আমি তো সর্বদেশের লোককে ঠেকাইয়া রাখিবার জন্য ব্ৰাহ্মধর্মের দরজায় কুলুপ লাগাইতে চেষ্টা করি নাই। হিন্দুও যে ব্ৰাহ্ম হইতে পারেন এই কথাই আমি বলিয়াছিলাম, কিন্তু ‘ব্রাহ্মধর্ম কেবল হিন্দুদের মধ্যে আবদ্ধ থাকিবে এমন অদ্ভুত কথা আমি কোনােদিন বলি নাই। তত্ত্বকৌমুদী-সম্পাদক মহাশয় প্রশ্ন করিয়াছেন, ব্ৰাহ্মসমাজে যে-সকল য়িহুদি মুসলমান য়ুরোপীয় আশ্রয় লইতেছেন তাহারা কি নিজেদের হিন্দু বলিয়া পরিচয় দিবেন ?“পরিচয় নানা প্রকারের আছে- কোনোটা সংকীর্ণ কোনোটা ব্যাপক । আমি ব্ৰাহ্ম বলিয়া আপনার পরিচয় দিলেই যে আমাকে হিন্দু পরিচয়ও গ্রহণ করিতে হইবে এমন কোনো কথা নাই। একজন ইংরেজ যে-অংশে ব্রাহ্ম কেবল সেই অংশেই হিন্দুর সহিত র্তাহার দেনাপাওনার একটা যোগ থাকিয়া গেল ; তাহাতে তাহার লজ্জার কারণ কিছুই নাই। আমরা হিন্দু হইয়াও ইংরেজি সাহিত্যে আনন্দ পাই, য়ুরোপীয় চিকিৎসায় প্রাণ বঁাচাই, রেলগাড়িতে অসংকোচে চড়ি, টেলিগ্রাফে খবর পাঠাইয়া দিই- চিন্তামাত্র করি না। তাহা আমাদের পিতৃপুরুষের উদ্ভাবিত সামগ্ৰী কি না । এইরূপে প্রতিদিনই দেখিতেছি বিশেষ মানবজাতির কীর্তিই সর্বসাধারণ মানবজাতির সম্পদ । বেদান্তদর্শনকে ভারতবষীয় দর্শন বলিয়া সম্পূর্ণ স্বীকার করিয়াও তাঁহাকে সত্য বলিয়া গ্ৰহণ করাতে জর্মন পণ্ডিত ডয়সনের যদি জর্মনত্বে কোনো বাধা না ঘটাইয়া থাকে। তবে ব্ৰাহ্মধর্মকে হিন্দু-ইতিহাসের সামগ্ৰী বলিয়া স্বীকার করিয়াও তাঁহাকে সত্য বলিয়া গ্রহণ করিতে মুসলমানের বা ইংরেজের বা য়িহুদির লেশমাত্র বাধা কেন থাকিবে ? সত্যকে কি মানুষ এমনি করিয়াই গ্ৰহণ করিতেছে না ? প্লেটাের রচনা কি গ্ৰীসের সীমার বাহিরে অস্পৃশ্য ? আরিস্টটলের দর্শন কি মুসলমান জ্ঞানী কোনোদিন সত্য বলিয়া গ্রহণ করেন নাই এবং সেই গ্রহণ করিবার শক্তি দ্বারাই কি তাহার গৌরবহানি হইয়াছিল ? বস্তুত ব্ৰাহ্মধর্ম বিশেষভাবে হিন্দুর চিত্তের সমস্ত রস লইয়া বিকশিত হইয়াছে বলিয়াই আহিন্দুর পক্ষে তাহার উপাদেয়ত বাড়িয়াছে নতুবা জগৎসংসারে তাহা নিতান্তই বাহুল্য হইয়া থাকিত, তাহা একটা পুনরাবৃত্তিমাত্র হইত, তাহার মধ্যে বিধাতার কোনো বিশেষ বিধান প্ৰকাশ হইতে পারিত না । তত্ত্বকৌমুদীর সম্পাদক মহাশয় অনাবশ্যক উত্তেজনার সহিত বারংবার বলিয়াছেন, খ্রীস্ট, মহম্মদ, থিওডোর পার্কার, মাটিন লুথর, মাটিনো সকলেই আমাদের গুরু**। তিনি তালিকা আরো অনেক বাড়াইয়া দিতে পারেন । তিনি যাহা বলিতেছেন তাহার সংক্ষেপ তাৎপর্য এই যে, মানবসমাজের মধ্যে যে দেশে যে জাতির মধ্যে যে-কেহ যে-কোনো সত্য আবিষ্কার ও প্রচার করিয়াছেন তিনি সেই বিষয়েই নিখিলমানবের গুরু । ইহাই সম্ভবপর বলিয়া আমরা সত্যকে অপরের নিকট হইতে গ্ৰহণ করিতে কুষ্ঠিত হই না । কিন্তু এই কথা কেবল পরের বেলাই খাটিবে নিজের বেলা খাটিবে না ? খ্রীস্টানের সত্য মুসলমানের সত্য আমি গ্রহণ করিতে পারি। কিন্তু আমার সত্য আমার বলিয়াই পাছে খ্রীস্টান ও মুসলমান গ্ৰহণ না করে এই কারণেই তাহা আমার সত্য নয় এমন কথা বলিতে হইবে ? বাম হাতের দিকে সত্যকে মানিব, আর ডান হাতের দিকে তাহাকে মানিব না ? লইবার বেলা এক কথা আর দিবার বেলা তাহার বিপরীত ? ৪৬ ‘ব্রাহ্মধর্মের মূল-মত ও অবাস্তর বিষয়, তত্ত্বকীেমুদী, ১ বৈশাখ ১৩১৯ ৪৭ “হিন্দু কি ?” তত্ত্বকৌমুদী, ১৬ চৈত্র ১৩১৮ ৪৮ ‘ভারতবর্ষে ব্ৰাহ্মধর্ম, তত্ত্বকৌমুদী, ১ বৈশাখ ১৩১৯