পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৪৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

যোগাযোগ \ONG ফুলপাতায় সভা সাজানো, ছাপাখানায় দাঁড়িয়ে থেকে সোনার কালিতে চিঠি ছাপানো, চৌকি কাপেট ভাড়া করে আনা, গেটে দাঁড়িয়ে অভ্যর্থনা, গলা ভাঙিয়ে পরিবেশন, কিছুই বাদ দিলে না। এই সুযোগে এমন বিষয়বুদ্ধি ও কাণ্ডজ্ঞানের পরিচয় দিলে যে, রজনীবাবু ভারি খুশি । তিনি কেজো মানুষ চেনেন, বুঝলেন এ ছেলের উন্নতি হবে । নিজের থেকে টাকা ডিপজিট দিয়ে মধুকে রাজবপুরে কেরোসিনের এজেন্সিতে বসিয়ে দিলেন । সৌভাগ্যের দৌড় শুরু হল ; সেই যাত্রাপথে কেরোসিনের ডিপো কোন প্রান্তে বিন্দু-আকারে পিছিয়ে পড়ল । জমার ঘরের মোটা মোটা অঙ্কের উপর পা ফেলতে ফেলতে ব্যাবসা হু-হু করে এগোেল গলি থেকে সদর রাস্তায়, খুচরো থেকে পাইকিরিতে, দোকান থেকে অপিসে, উদযোগপর্ব থেকে স্বৰ্গারোহণে। সবাই বললে, “একেই বলে কপাল!” অর্থাৎ পূর্বজন্মের ইস্টিমেতেই এ জন্মের গাড়ি চলছে। মধুসূদন নিজে জানত যে, তাকে ঠকাবার জন্যে অদৃষ্টের ক্রটি ছিল না, কেবল হিসেবে ভুল করে নি বলেই জীবনের অঙ্ক-ফলে পরীক্ষকের কাটা দাগ পড়ে নি। যারা হিসেবের দোষে ফেল করতে মজবুত, পরীক্ষকের পক্ষপাতের পরে তারাই কটাক্ষপাত করে থাকে। মধুসূদনের রািশ ভারী। নিজের অবস্থা সম্বন্ধে কথাবার্তা কয় না। তবে কিনা আন্দাজে বেশ বোঝা যায়, মরা গাঙে বান এসেছে। গৃহপালিত বাংলাদেশে এমন অবস্থায় সহজ মানুষে বিবাহের চিন্তা করে, জীবিতকালবতী সম্পত্তিভোগটাকে বংশাবলীর পথ বেয়ে মৃত্যুর পরবতী ভবিষ্যতে প্রসারিত করবার ইচ্ছা তাদের প্রবল হয়। কন্যাদায়িকেরা মধুকে উৎসাহ দিতে ত্রুটি করে না, মধুসূদন বলে, “প্ৰথমে একটা পেট সম্পূর্ণ ভরলে তার পরে অন্য পেটের দায় নেওয়া চলে।” এর থেকে বোঝা যায়, মধুসূদনের হৃদয়টা যাই হােক, পেটটা ছােটাে নয়। এই সময়ে মধুসূদনের সতর্কতায় রাজবপুরের পাটের নাম দাড়িয়ে গেল। হঠাৎ মধুসূদন সব-প্রথমেই নদীর ধারের পোড়ো জমি বেবাক কিনে ফেললে, তখন দর সস্তা। ইটের পাজ পোড়ালে বিস্তর, নেপাল থেকে এল। বড়ো বড়ো শালকাঠ, সিলেট থেকে চুন, কলকাতা থেকে মালগাড়ি-বোঝাই করোগেটেড লোহা । বাজারের লোক অবাক ! ভাবলে, “এই রে ! হাতে কিছু জন্মেছিল, সেটা সইবে কেন । এবার বদহজমের পালা, কারবার মরণব্দশায় ঠেকাল বলে |’ এবারও মধুসূদনের হিসেবে ভুল হল না । দেখতে দেখতে রজবপুরে ব্যাবসার একটা আওড় লাগল। তার ঘূর্ণিটানে দালালরা এসে জুটল, এল মাড়োয়ারির দল, কুলির আমদানি হল, কল বসল, চিমনি থেকে কুণ্ডলায়িত ধূমকেতু আকাশে-আকাশে কালিমা বিস্তার করলে। । হিসেবের খাতার গবেষণা না করেও মধুসূদনের মহিমা এখন দূর থেকে খালি-চােখেই ধরা পড়ে। একা সমস্ত গঞ্জের মালিক, পাচিল-ঘেরা দোতলা ইমারত, গেটে শিলাফলকে লেখা ‘মধুচক্ৰ' । এ-নাম তার কলেজের পূর্বতন সংস্কৃত অধ্যাপকের দেওয়া। মধুসূদনকে তিনি পূর্বের চেয়ে অকস্মাৎ এখন অনেক বেশি স্নেহ করেন । л এইবার বিধবা মা ভয়ে ভয়ে এসে বললে, “বাবা, কবে মরে যাব, বউ দেখে যেতে পারব না কি ?” মধু গভীরমুখে সংক্ষেপে উত্তর করলে, “বিবাহ করতেও সময় নষ্ট, বিবাহ করেও তাই। আমার ফুরসত কোথায় ?” পীড়াপীড়ি করে এমন সাহস ওর মায়েরও নেই, কেননা সুময়ের বাজার-দর আছে। সবাই জানে মধুসূদনের এক কথা । আরো কিছুকাল যায়। উন্নতির জোয়ার বেয়ে কারবারের আপিস মফস্বল থেকে কলকাতায় উঠল। নাতিনাতনীর দর্শনসুখ সম্বন্ধে হাল ছেড়ে দিয়ে মা ইহলোক ত্যাগ করলে। ঘোষাল কোম্পানির নাম আজ দেশবিদেশে, ওদের ব্যাবসা বনেদি বিলিতি কোম্পানির গা ঘেঁষে চলে, বিভাগে বিভাগে ইংরেজ ম্যানেজার। মধুসূদন এবার স্বয়ং বললে, বিবাহের ফুরসত হল। কন্যার বাজারে ক্রেডিট তার সর্বোক্ষে । অতিবড়ো অভিমানী ঘরেরও মানভঞ্জন করবার মতো তার শক্তি । চার দিক থেকে অনেক কুলবতী