পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৬৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

VO8r রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী যেমন করে মাটি আঁকড়ে থাকতে চায়, দাদার পায়ের কাছে কুমুর তেমনি এই শেষ ব্যগ্রতার বন্ধন । ডাক্তার আবার এসে ধীরে ধীরে বললে, “আর নয় দিদি।” বলে নিজের অশ্রুসিক্ত চোখ মুছে ফেললে । ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়ে দরজার বাইরে যে চৌকিটা ছিল তার উপর বসে পড়ে মুখে আঁচল দিয়ে কুমুনিঃশব্দে কঁদিতে লাগল। হঠাৎ এক সময়ে মনে পড়ে গেল দাদার ‘বেসি’ ঘোড়াকে নিজের হাতে খাইয়ে দিয়ে যাবে বলে কাল রাত্রে সে গুড়মাখা আটার রুটি তৈরি করে রেখেছিল । সইস আজ ভোরবেলায় তাকে খিড়কির বাগানে রেখে এসেছে। কুমু সেখানে গিয়ে দেখলে ঘোড়া আমড়াগাছতলায় ঘাস খেয়ে বেড়াচ্ছে। দূর থেকে কুমুর পায়ের শব্দ শুনেই কান খাড়া করলে এবং তাকে দেখেই চিহি। হিঁহি করে ডেকে উঠল। বা হাত তার কাধের উপর রেখে ডান হাতে কুমু তার মুখের কাছে রুটি ধরে তাকে খাওয়াতে লাগল। সে খেতে খেতে তার বড়ো বড়ো কালো স্নিগ্ধ চোখে কুমুর মুখের দিকে কটাক্ষে চাইতে লাগল। খাওয়া হয়ে গেলে বেসির দুই চোখের মাঝখানকার প্রশস্ত কপালের উপর চুমো খেয়ে কুমু দৌড়ে চলে গেল । r Sbr বিপ্রদাস নিশ্চয় মনে করেছিল মধুসূদন এই কয়দিনের মধ্যে একবার এসে দেখা করে যাবে। তা যখন করলে না। তখন ওর বুঝতে বাকি রইল না যে, দুই পরিবারের এই বিবাহের সম্বন্ধটাই এল পরস্পরের বিচ্ছেদের খড়গ হয়ে | রোগের নিরতিশয় ক্লাস্তিতে এ কথাটাকেও সহজভাবে সে মেনে নিলে। ডাক্তারকে ডেকে জিজ্ঞাসা করলে, “একটু এসরাজ বাজাতে পারি কি ?” ডাক্তার বললে, “না, আজ থাক ৷” “তা হলে কুমুকে ডাকো, সে একটু বাজাক । আবার কবে তার বাজনা শুনতে পাব, কে জানে ৷” ডাক্তার বললে, “আজ সকালে ন-টার গাড়িতে ওঁদের ছাড়তে হবে, নইলে সূর্যাস্তের আগে কলকাতায় পৌঁছতে পারবেন না । কুমুর তো আর সময় নেই।” বিপ্রদাস নিশ্বাস ফেলে বললে, “না, এখানে ওর সময় ফুরোল । উনিশ বছর কাটতে পেরেছে, এখন এক ঘণ্টাও আর কাটবে না ।” বিদায়ের সময় স্বামী-স্ত্রী জোড়ে প্ৰণাম করতে এল। মধুসূদন ভদ্রতা করে বললে, “তাই তো, আপনার শরীর তো ভালো দেখছি নে ৷” বিপ্ৰদাস তার কোনো উত্তর না করে বললে, “ভগবান তোমাদের কল্যাণ করুন ।” “দাদা, নিজের শরীরের একটু যত্ন কোরো” বলে আর-একবার বিপ্রদাসের পায়ের কাছে পড়ে কুমু कैप्रिख्, व्लॉ6व्न । হুলুধ্বনি শঙ্খধ্বনি ঢাক-কঁাসির-নহবতে একটা আওয়াজের সাইক্লোন ঝড় উঠল । ওরা গেল চলে । পরম্পরের আঁচলে চাদরে বাধা ওরা যখন চলে যাচ্ছে সেই দৃশ্যটা আজ, কেন কী জানি, বিপ্রদাসের কাছে বীভৎস লাগল। প্রাচীন ইতিহাসে তৈমুর জঙ্গিস অসংখ্য মানুষের কঙ্কালস্তম্ভ রচনা করেছিল। কিন্তু ঐ-যে চাদরে-আঁচলের গ্রন্থি, ওর সৃষ্ট জীবন-মৃত্যুর জয়তোরণ যদি মাপা যায়। তবে তার চুড়া কোন নরকে গিয়ে ঠেকবে ! কিন্তু এ কেমনতরো ভাবনা আজ ওর মনে ! পূজাৰ্চনায় বিপ্রদাসের কোনোদিন উৎসাহ ছিল না। তবু আজ হাত জোড় করে মনে মনে প্রার্থনা कख़ड क्योंकि ! এক সময়ে চমকে উঠে বললে, “ডাক্তার, ডাকো তো দেওয়ানজিকে ৷” বিপ্রদাসের হঠাৎ মনে পড়ে গেল, বিয়ে দিতে আসবার কিছুদিন আগে যখন সুবোধকে টাকা পাঠানো নিয়ে মন অত্যন্ত উদবিগ্ন, হিসাবের খাতপত্র ঘেঁটে ক্লান্ত, বেলা এগারোটা- এমন সময়ে অত্যন্ত বে-মেরামত গোছের একটা মানুষ, কিছুকালের না-কামানাে কণ্টকিত জীর্ণ মুখ, হাড়-বের করা শির-বের-করা হাত, ময়লা একখানা চাদর, খাটাে একখানা ধুতি, ছেড়া একজোড়া চটি-পরা, এসে উপস্থিত। নমস্কার করে বললে, “বড়োবাবু, মনে পড়ে কি ?”