পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৯৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Vro রবীন্দ্র-রচনাবলী এখানে আসবার তো দরকার ছিল না ।” কুমু একটুখানি চুপ করে রইল, মনকে শান্ত করে তার পরে বললে, “এ চিঠি তুমি আমাকে পড়তে দিতে ইচ্ছে কর নি, সেইজন্যে এ চিঠি আমি পড়ব না। এই আমি ছিড়ে ফেললুম। কিন্তু এমন কষ্ট আমাকে আর কখনো দিয়ে না। এর চেয়ে কষ্ট আমার আর কিছু হতে পারে না।” এই বলে সে মুখে কাপড় দিয়ে ছুটে বেরিয়ে চলে গেল। ইতিপূর্বে আজ মধ্যাহ্নে আহারের পর মধুসূদনের মনটা আলোড়িত হয়ে উঠেছিল। আন্দােলন কিছুতে থামাতে পারছিল না। কুমুর খাওয়া হলেই তাকে ডাকিয়ে পাঠাবে বলে ঠিক করে রেখেছে। আজ সে মাথার চুল আঁচড়ানো সম্বন্ধে একটু বিশেষ যত্ন নিলে। আজ সকালেই একটি ইংরেজ নাপিতের দোকান থেকে স্পিরিট-মেশানো সুগন্ধি কেশতৈল ও দামি এসেন্স কিনিয়ে আনিয়েছিল। জীবনে এই প্ৰথম সেগুলি সে ব্যবহার করেছে। সুগন্ধি ও সুসজ্জিত হয়ে সে প্রস্তুত ছিল। আপিসের সময় আজ অন্তত পঁয়তাল্লিশ মিনিট পেরিয়ে গেল । সিঁড়িতে পায়ের শব্দ পেতেই মধুসূদন চমকে উঠে বসল। হাতের কাছে আর-কিছু না পেয়ে একখানা পুরোনো খবরের কাগজের বিজ্ঞাপনের পাতাটা নিয়ে এমন ভাবে সেটাকে দেখতে লাগল যেন তার আপিসেরই কাজের অঙ্গ । এমন-কি, পকেট থেকে একটা মোটা নীল পেন্সিল বের করে দুটাে-একটা দাগও টেনে দিলে। এমন সময়ে ঘরে প্রবেশ করলে শ্যামাসুন্দরী । ভুকুঞ্চিত করে মধুসূদন তার মুখের দিকে চাইলে । শ্যামাসুন্দরী বললে, “তুমি এখানে বসে আছ ; বউ যে তোমাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে।” “খুঁজে বেড়াচ্ছে! কোথায় ?” “এই যে দেখলুম, বাইরে তোমার আপিসঘরে গিয়ে ঢুকল। তা এতে অত আশ্চর্য হচ্ছে কেন ঠাকুরপো- সে ভেবেছে তুমি বুঝি--” তাড়াতাড়ি মধুসূদন বাইরে চলে গেল। তার পরেই সেই চিঠির ব্যাপার। পালের নীেকায় হঠাৎ পাল ফেটে গেলে তার যে দশা মধুসূদনের তাই হল। তখন আর দেরি করবার লেশমাত্র অবকাশ ছিল না ! আপিসে চলে গেল । কিন্তু সকল কাজের ভিতরে ভিতরে তার অসম্পূর্ণ ভাঙা চিন্তার তীক্ষ ধারগুলো কেবলই যেন ঠেলে ঠেলে বিধে বিধে উঠছে। এই মানসিক ভূমিকম্পের মধ্যে মনােযোগ দিয়ে কাজ করা সেদিন তার পক্ষে একেবারে অসম্ভব। আপিসে জানিয়ে দিলে উৎকট মাথা ধরেছে, কার্যশেষের অনেক আগেই বাড়ি ফিরে এল । V) ( . এ দিকে নবীন ও মেতির মা বুঝেছে এবারে ভিত গেল ভেঙে, পালিয়ে বাঁচবার আশ্রয় তাদের আর কোথাও রইল না । মোতির মা বললে, “এখানে যেরকম খেটে খাচ্ছি। সেরকম খেটে খাবার জায়গা সংসারে আমার মিলবে। আমার দুঃখ এই যে, আমি গেলে এ বাড়িতে দিদিকে দেখবার লোক আর কেউ থাকবে না ।” নবীন বললে, “দেখো মেজেবিউ, এ সংসারে অনেক লাঞ্ছনা পেয়েছি, এ বাড়ির অন্নজলে অনেকবার আমার অরুচি হয়েছে। কিন্তু এইবার অসহ্য হচ্ছে যে, এমন বউ ঘরে পেয়েও কী করে তাকে নিতে হয়, রাখতে হয়, তা দাদা বুঝলে না- সমস্ত নষ্ট করে দিলে। ভালো জিনিসের ভাঙা টুকরো দিয়েই অলক্ষ্মী বাসা বাধে।” মোতির মা বললে, “সে কথা তোমার দাদার বুঝতে দেরি হবে না। কিন্তু তখন ভাঙা আর জোড়া ठा?igद का ।” নবীন বললে, “লক্ষ্মণ-দেওর হবার ভাগ্য আমার ঘটল না, এইটেই আমার মনে বাজছে। যা হােক, তুমি জিনিসপত্তর এখনই গুছিয়ে ফেলো, এ বাড়িতে যখন সময় আসে তখন আর তার সয় না।” মোতির মা চলে গেল। নবীন আর থাকতে পারলে না, আস্তে আস্তে তার বউদিদির ঘরের বাইরে